মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কী কারণ ছিল বুদ্ধিজীবীদের হত্যার?

সামিন রহমান
১৪ ডিসেম্বর ২০২০ ২১:৩১ |আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২১ ১৬:০১
ছবিতে শহীদ বুদ্ধিজীবীরা
ছবিতে শহীদ বুদ্ধিজীবীরা

বাঙালি জাতির ইতিহাসে বুদ্ধিজীবী শ্রেণির অবদান অসামান্য। প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে বাঙালি জাতির ইতিহাসে বুদ্ধিজীবীরা নানা চেতনা জাগিয়ে ও পরামর্শ দান করে জাতিকে সঠিক পথ নির্দেশনা দিয়েছেন।

মাতৃভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ ও অত্যাচার সম্পর্কে সর্বপ্রথম বুদ্ধিজীবীরাই সাধারণ মানুষকে অবগত করেছিলেন। তারাই পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্য তুলে ধরেছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন, শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে তারা সর্বদা সোচ্চার ছিলেন। প্রতিটি আন্দোলনে বাঙালির চেতনা জাগ্রত করতে তাদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম।

প্রায় ২৪ বছরের পাকিস্তানি শাসকদের জুলুম, নির্যাতন, নিপীড়ন নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ভাষণ দেন। এ ভাষণেই বঙ্গবন্ধু যুদ্ধের আভাস দিয়েছিলেন। যুদ্ধের আভাস পেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকেরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ বাংলাদেশের অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের অন্যতম লক্ষ্যবস্তু হিসেবে চিহ্নিত করে। কেননা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে জানতেন, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা সাধারণ জনগণকে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষমতা রাখেন। তাই ২৫ মার্চ কাল রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অন্যতম লক্ষ্য ছিল বুদ্ধিজীবী হত্যা। পরিকল্পনা অনুসারে, তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালায় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে সেদিন রাতেই হত্যা করা হয়। 

২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন এবং সেদিন থেকেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই অবশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা নানাভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে জনগণকে অনুপ্রাণিত করে আসছিলেন। তারা তাদের লেখনী, বুদ্ধি ও নানা সৃষ্টি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ দিয়েছেন।

যুদ্ধের শুরু থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মূল টার্গেট বুদ্ধিজীবীরা থাকলেও তাদের এ পরিকল্পনার ব্যাপক অংশটি ঘটে যুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র কদিন আগে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের পরাজয় নিশ্চিত জেনে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যা করার ঘৃণ্য পরিকল্পনা করে। বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রধান কারণ ছিল দুটি। প্রথমটি ছিল - বাঙালি জাতিকে নেতৃত্বহীন করা। দ্বিতীয়টি ছিল - স্বাধীন হতে যাওয়া দেশটিকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে দেউলিয়ায় পরিণত করা।

বুদ্ধিজীবীরাই জাগিয়ে রাখেন একটি জাতির বিবেকবোধ ও চেতনা - সাহিত্যিকরা তাদের রচনাবলীর মাধ্যমে, সাংবাদিকরা তাদের কলমের মাধ্যমে, গায়করা তাদের সুরের মাধ্যমে, শিক্ষকরা পাঠদানের মাধ্যমে, চিকিৎসকরা সুস্থ রাখার মাধ্যমে, প্রকৌশলীরা তাদের গাণিতিক ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের মাধ্যমে এবং রাজনীতিবিদরা তাদের চিন্তার মাধ্যমে। তাই একটি জাতির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেওয়ার সর্বোত্তম উপায় বুদ্ধিজীবী শূন্য করে দেওয়া। মূলত এ কারণেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১০ ডিসেম্বর হতে বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা করা শুরু করে এবং ১৪ ডিসেম্বর মূল পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়।

এ ষড়যন্ত্রে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সাহায্য করে কিছু বাঙালি কুলাঙ্গার - রাজাকার, আল বদর ও আল শামস। তারা একে একে ধরে নিয়ে যায় বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। এদের মধ্যে ছিলেন শিক্ষাবিদ, গবেষক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, চিকিৎসক, শিল্পী, কবি, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিকসহ অনেকেই। তাদের চোখে কালো কাপড় বেঁধে জোরপূর্বক নিয়ে যাওয়া হয় মিরপুর, মোহাম্মদপুর, নাখালপাড়া, রাজারবাগসহ আরও অনেক স্থানে অবস্থিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতন কেন্দ্রে। তাদের ওপর নির্মম ও নিষ্ঠুর অত্যাচার চালিয়ে হত্যা করা হয়।

কাউকে পুঁতে ফেলা হয়, আবার কাউকে টুকরো টুকরো করে হত্যা করা হয়। তাদের অনেকের লাশ খুঁজে পাওয়া যায় রায়েরবাজার ও মিরপুর বধ্যভূমিতে, আবার কারও কারও লাশ খুঁজেই পাওয়া যায়নি। যাদের লাশ খুঁজে পাওয়া গেছে, তাদের লাশ ছিল ক্ষতবিক্ষত অবস্থায়, যা দেখে আত্মীয়-স্বজনেরা বিমর্ষ হয়ে পড়েছিল। চোখ-মুখ বাঁধা, জবাই করা লাশ দেখে অনুমান করতে কষ্ট হয়নি, পাকিস্তানিরা তাদের পরাজয় মেনে না নিতে পারার ক্ষোভ, দুঃখ ও হতাশার ক্ষতচিহ্ন এ দেশের সূর্য সন্তানদের শরীরে রেখে গেছে।

বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের সাময়িক উপদেষ্টা রাও ফরমান আলী। স্বাধীনতা লাভের পর গভর্নর হাউজে তার রেখে যাওয়া একটি ডায়েরি থেকে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের একটি তালিকা পাওয়া যায়, যার অধিকাংশই নিহত হয়েছে ১৪ ডিসেম্বর। বাংলাপিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, মোট ১ হাজার ১১১ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়। যাদের মধ্যে ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক ৪৯ জন, আইনজীবী ৪২ জন, সাংবাদিক ১৩ জন এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও প্রকৌশলী ১৬ জন।

মহান মুক্তিযুদ্ধে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হলেও পরাজিত পাকিস্তানিরা বুদ্ধিজীবী হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের এমন একটি ক্ষতি করে যায়, যে ক্ষতি আজ অব্দি পূরণ করা সম্ভব হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, বুদ্ধিজীবী হত্যার কারণে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে গেছে। বুদ্ধিজীবী হত্যার কারণেই আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের প্রায় অর্ধশতাব্দী হতে চলছে, কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক সুবিচার, গণতান্ত্রিক পরিবেশ এখনো পূর্ণতা পায়নি।

বুদ্ধিজীবীরা স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম কারিগর। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পেছনে বুদ্ধিজীবীরা অস্ত্র হাতে নয়, বরং নেতৃত্ব দিয়েছিল চিন্তার মাধ্যমে। তাই পাকিস্তানিরা একটি জাতিকে ভঙ্গুর ও নিষ্ক্রিয় করতে এক বিন্দুও ছাড় দেয়নি, যার পরিণতি এখনো ভোগ করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের চিন্তা, চেতনা ও কর্মকে লালন করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে আমাদের। তা না হলে এ পরিণতি ভোগ করে যেতে হতে পারে আজীবন।

 

 

লেখক : সামিন রহমান

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়



মন্তব্য করুন