চ্যাটজিপিটি : শঙ্কা নাকি সম্ভাবনা?

প্রতীকী ছবি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ কম্পিউটার বিজ্ঞানী অ্যালান ট্যুরিং তার এক নিবন্ধে প্রশ্ন রেখেছিলেন, যন্ত্র কি কখনো মানুষের মতো ভাবতে পারবে? তার প্রশ্নের উত্তর বোধহয় পাওয়া গেছে। ইসরাইলি ইতিহাসবিদ য়্যুভাল নোয়া হারারি তার বিখ্যাত বই ‘সেপিয়েন্স’-এ বলেছিলেন, আমরাই সম্ভবত হোমো সেপিয়েন্স তথা মানুষের সবশেষ প্রজন্ম। দুজনেরই প্রশ্ন এবং মন্তব্যের মূল কারণ এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
নোয়া হারারি মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম সিবিএস নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমরা মানুষরা আমাদের শরীর-মস্তিস্কের ওপর রীতিমতো কারিগরি ফলাচ্ছি। কখনো আমরা নিজেদের শরীরে সরাসরি জৈবরাসায়নিক পরিবর্তন ঘটাচ্ছি, আবার কখনো আমাদের মস্তিস্কের সঙ্গে কম্পিউটারে কৃত্রিম সংযোগ ঘটাচ্ছি। সম্পূর্ণরূপে অজৈব সত্তা তৈরি করে আমাদের জৈব শরীরে স্থাপন করছি। এর সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই। ফলে আমাদের শরীর কোনোভাবেই আর হোমো সেপিয়েন্সের বিশুদ্ধ শরীর থাকছে না।’
নোয়া হারারি তার আরেক বই ‘একুশ শতকে টিকে থাকার একুশ শিক্ষাতে’-আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) নিয়ে আশাবাদ প্রকাশ করেছেন, সম্ভাবনা দেখিয়েছেন। কিন্তু এআই কি কেবল ইতিবাচক দিক নিয়েই হাজির হয়েছে? বিশেষ করে এআই চ্যাটবট ‘চ্যাটজিপিটি’ বাজারে আসার পর থেকেই নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে, এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং চ্যাটজিপিটির বিকাশ আমাদের ভবিষ্যতকে কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে? বিশেষ করে চ্যাটজিপিটি আমাদের কোন দিকে নিয়ে যাবে? শঙ্কা নাকি সম্ভাবনার পথে?
এরই মধ্যে, চ্যাটজিপিটি নিয়ে নানা ধরনের শঙ্কা ও সম্ভাবনার কথা তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে শিক্ষা খাতে চ্যাটজিপিটির প্রভাব নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনপিআরের এক নিবন্ধে এমা বোম্যান শিক্ষাখাতে চ্যাটজিপিটির নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেছেন।
তিনি বলেছেন, চ্যাটজিপিটির মতো এআই-এর বিকাশের ফলে শিক্ষাখাতের চরিত্র আগের মতো নাও থাকতে পারে।
চ্যাটজিপিটির ইতিবাচক দিক নিয়েও বলেছেন এমা। তার মতে চ্যাটজিপিটি যেমন পুরনো তথ্য মনে রেখে তা সংশোধন এবং পরিবর্তনের সুযোগ দেয় তেমনি তা ব্যবহারকারীর অপ্রয়োজনীয় অনুরোধও উপেক্ষা করতে পারে। কিন্তু এই চ্যাটবটটি দরকারি তথ্যের বদলে অদরকারি এবং ভুল তথ্যও দিতে পারে, তৈরি করতে পারে ক্ষতিকর নির্দেশনা এবং পক্ষপাতদুষ্ট কনটেন্ট।
এমা আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। তা হলো, এ চ্যাটবট আমাদের পৃথিবীর সভ্যতা এবং মানবজাতির বিকাশ সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা রাখে না। ফলে কন্টেন্ট অনেক সময় অগভীর এবং পক্ষপাতদুষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
এআই আরও একটি কারণে নেতিবাচক। কারণ এর ফলে শিক্ষার্থীরা ব্রেইনওয়ার্কের বদলে এআইয়ের সহায়তা নেবে। এই বিষয়ে আশঙ্কা ব্যক্ত করে ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার অধ্যাপক ইথান মল্লিক বলেছেন, ‘এআই শিক্ষার্থীদের হোমওয়ার্ক কমিয়ে দেবে, যা তাদের মস্তিস্কের কর্মকাণ্ড কমিয়ে দেবে।’
চ্যাটজিপিটির আরও নেতিবাচক দিক রয়েছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষকে মানবীয় অনুভূতির ছোঁয়া কখনোই দিতে পারবে না। সেটি ব্যক্তির জন্য তথ্যের যোগান দিতে পারবে, তার জন্য গান কবিতাও হয়তো লিখে দিতে পারবে কিন্তু তা কখনোই মানুষকে মানবীয় অনুভূতির জায়গা থেকে স্পর্শ করতে পারবে না। এই বিষয়টি মাথায় রেখেই হয়তো চ্যাটজিপিটির মাতৃপ্রতিষ্ঠান ওপেনএআই-এর সিইও স্যাম অল্টম্যান মজার ছলে বলেছিলেন, ‘চ্যাটজিপিটির সক্ষমতা খুবই সীমিত। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি খুবই দারুণ। বিশেষ করে কোনো কিছুর ভুয়া ইমেজ তৈরিতে এর জুড়ি নেই।’
চ্যাটজিপিটি উন্মুক্ত হওয়ার পর আরও একটি বিষয় আবারও আলোচনায় এসেছে। বিশেষ করে এআইয়ের কারণে মানুষের চাকরি হুমকির মুখে পড়বে কিনা তা নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ বিষয়ে সিদ্ধান্তমূলক মন্তব্য করার সময় এখনো আসেনি।
একদল বিশ্লেষকের মতে, এআই হয়তো কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষের কাজ করবে তবে তা আরও নতুন নতুন চাকরির বাজারও তৈরি করবে। যেমন মাইক্রোসফট করপোরেশন ঘোষণা দিয়েছে, তারা এআই ব্যবহার করে ‘সিটিজেন ডেভেলপার’ তৈরি করবে, যা কোনোভাবেই মানুষের চাকরিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না। কারণ মানুষ প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাবে এবং অন্যান্য দক্ষতার ভিত্তিতে মানুষের কাজের জন্য নতুন নতুন শিল্প গড়ে উঠবে।
তবে অনেকের আশঙ্কা, এআই নতুন করে মানুষ এবং তাদের কাজকে হুমকির মুখে ফেলবে। কিন্তু আসলেই কি তাই? ইংল্যান্ডে যখন স্টিম ইঞ্জিন আবিষ্কার হয়, কাপড়ের মিল চালু হয় তখন অনেকেই ধারণা করেছিল মানুষ তার চাকরি হারাবে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। মানুষের জন্য কাজের অভাব পড়েনি কখনো। তেমনি চ্যাটজিপিটি হয়তো মানুষের অনেক কাজ সহজ করে দেবে। মানুষের হয়ে গল্প-কবিতা এমনকি সংবাদও লিখে দেবে। হয়তো মানুষের জায়াগায় বাজার বিশ্লেষণ, শেয়ার বিনিয়োগ ইত্যাদি কাজও করে দেবে। কিন্তু তারপরও মানুষকে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব নয়। কারণ এআই এখনো ততটা মানবিক অনুভূতি সম্পন্ন হয়ে উঠতে পারেনি যতটা হলে তা মানুষের অনুভূতিকে ছুঁয়ে যেতে পারে। এআই এখনো ততটা দক্ষ হয়ে উঠতে পারেনি যতটা দক্ষ হয়ে উঠলে মানুষের সাহায্য ছাড়াই বড় কোনো বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলতে পারবে।
সবমিলিয়ে, চ্যাটজিপিটি কিংবা এআই আমাদের জন্য আশঙ্কার নয়। অন্তত এখনই নয়। বিষয়টি বলতে গেলে এখনো অনেকটা বিকশিত হওয়ার পর্যায়ে রয়েছে। আরও সময় লাগবে। তারপর হয়তো বলা সম্ভব, এআইয়ের ভবিষ্যৎ কোন পথে; শঙ্কার নাকি সম্ভাবনার। আপাতত এআইয়ের সুবিধা মানুষকে কতটা সুবিধা দেয়, এসব সুবিধার বিপরীতে সুযোগ ব্যয়ের মতো কী কী সুবিধা মানুষকে ত্যাগ করতে হবে এবং এসব সুবিধার বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে কী কী অসুবিধা মানুষকে ভোগ করতে হতে সে বিষয়গুলোই আছে আলোচনায়।
আগামীর বিশ্বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই ভবিষ্যৎ। বিশ্বের বড় বড় টেক প্রতিষ্ঠানগুলো এরই মধ্যে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। গুগল তো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে। ঘোষণা দিয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের। একই পথে হেঁটেছে আরেক টেক জায়ান্ট মাইক্রোসফটও। পিছিয়ে নেই অ্যাপল, আমাজনের মতো অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে আগামী দিনের পৃথিবীর অর্থ-বাণিজ্যও কেন্দ্রীভূত হতে পারে এআই খাতে।
এ নিয়ে ওপেন এআইয়ের সিইও স্যাম অল্টম্যানের বক্তব্য হলো, ‘গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজের জন্য এখনই চ্যাটজিপিটির ওপর নির্ভরশীল হওয়া ঠিক হবে না। এখন কেবল বিষয়টি নিয়ে আমরা পর্যবেক্ষণ-পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের এর বিশাল আকার এবং নির্ভুলতা নিয়ে আরও কাজ করতে হবে।’ ফলে বলাই যায়, এখনই চ্যাটজিপিটি নিয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তমূলক অবস্থানে যাওয়ার সময় আসেনি।
তথ্যসূত্র: ইন্ডিয়া টুডে, রয়টার্স, ফোর্বস, এনপিআর এবং সিবিএস
মন্তব্য করুন