ঠাকুরগাঁওয়ে জীবন্ত সালাহউদ্দিনকে ছিঁড়ে খেয়েছিল বাঘ
বাঘের খাঁচায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল সালাহউদ্দিনকে
১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বর। ভয়ংকর নির্যাতনের পর পাকিস্তানি সেনারা ক্যাম্পে থাকা বাঘের খাঁচায় ছুড়ে ফেলল এক তরুণকে। সঙ্গে সঙ্গে হুংকার দিয়ে দুটো বাঘ ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। টেনে-হেঁচড়ে ছিন্নভিন্ন করে খেয়ে ফেলল তাকে!
মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের তথ্য বের করতে না পেরে এভাবেই ঠাকুরগাঁওয়ের ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) ক্যাম্পে নির্মম নির্যাতনের পর বাঘের খাঁচায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সালাহউদ্দিনকে। তিনি ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ঠাকুরগাঁও ছিল দিনাজপুর জেলার একটি মহকুমা। আর এই মহকুমার পীরগঞ্জ থানার কোষারানীগঞ্জ গ্রামেই জন্মেছিলেন শহীদ সালাহউদ্দিন।
শহীদ সালাহউদ্দিনের পরিবার, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও প্রামাণ্য সালাহউদ্দিন (বাঘের খাঁচায় মুক্তিযোদ্ধার প্রাণোৎসর্গ) গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী দিনাজপুরের বিভিন্ন এলাকায় চরম গণহত্যা চালায়। তারা ১৮ এপ্রিল পীরগঞ্জে গণহত্যা চালাতে গিয়ে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটসহ নারী নির্যাতন চালায়।
সে সময় গণহত্যার ভয়ে অনেকেই গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যান। আবার অনেকেই যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। ওই সময়ে দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র সালাহউদ্দিনও সীমান্ত পাড়ি দিয়ে চলে যান ভারতে। পরে প্রশিক্ষণ শেষ করে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। অস্ত্র হাতে অপারেশন শেষে ছুটতে থাকেন একের পর এক এলাকায়।
১৯৭১ সালের ১০ নভেম্বর। সহযোদ্ধাদের সঙ্গে সালাহউদ্দিন ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জের জাবরহাট ক্যাম্পে অবস্থান করেছিলেন। সে সময় একটা দুঃসংবাদ এলো। সালাহউদ্দিনের বাবাকে পাকিস্তানি সেনারা ধরে নিয়ে গেছে ইপিআর ক্যাম্পে। ভেঙে পড়লেন সালাহউদ্দিন। গভীর রাতে একজন সহযোদ্ধাকে জানিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলেন তিনি। ১১ থেকে ১২ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছে গেলেন বাড়ি। ‘মা, মা...’ বলে ডাকতেই খুলে গেল ঘরের দরজার কপাট। পরিবারের সদস্যরা সালাহউদ্দিনকে দেখে আত্মহারা।
এদিকে, সালাহউদ্দিন যখন গ্রামে ঢুকছিলেন, তখন রাজাকাররা তাকে দেখে ফেলে। খবর চলে যায় পাকিস্তানি সেনা সদর দপ্তরেও। পরে সকাল ১০টার দিকে সালাহউদ্দিনের বাড়ি ঘিরে ফেলে পাকিস্তানি সেনারা। টের পেয়ে সালাহউদ্দিন পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও পারলেন না। সালাহউদ্দিনের মা নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও পাকিস্তানি সেনাদের কাছে ছেলের প্রাণ ভিক্ষা চেয়েও ব্যর্থ হন। তবে তিনি ঘর থেকে কোরআন শরিফ এনে ক্যাপ্টেনের হাতে দিয়ে বললেন, ‘আমার বাবাকে মারবে না, শুধু এটুকু কথা বলে যাও।’ কোরআন ছুঁয়ে ক্যাপ্টেন বলে যান- ‘নেহি মারুঙ্গা উনকো।’
এরপর পাকিস্তানি সেনারা সালাহউদ্দিনকে বন্দি করে নিয়ে যায় ঠাকুরগাঁওয়ের ইপিআর ক্যাম্পে (বর্তমান ঠাকুরগাঁও বিজিবির সদর দপ্তর)। সেখানেই পাকিস্তানি সেনাদের সদর দপ্তর ছিল। সেখানে এনে সালাহউদ্দিনের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের তথ্য বের করার চেষ্টা চালায় পাকিস্তানি সেনারা। কিন্তু সালাহউদ্দিন তাদের কোনো তথ্য দেননি। এরপর তার ওপরে ভয়ংকর নির্যাতন চালাতে শুরু করে পাক সেনারা। প্রথমে ভয়ভীতি, পরে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে নির্যাতনের মাত্রা। চোখের মণিতে বড়শি বিঁধিয়ে নিষ্ঠুরভাবে টানাটানি করা হল। তবুও অনড় সালাহউদ্দিন। নির্যাতনের একপর্যায়ে কেটে নেওয়া হলো হাতের আঙুল। হাতে-পায়ে পেরেক ঠুকে তাকে ঝুলিয়ে রাখা হলো। তারপরও বিন্দুমাত্র মচকানো গেল না সালাহউদ্দিনকে।
শেষ পর্যন্ত সালাহউদ্দিনকে ঘিরে এক বর্বর সিদ্ধান্ত নেয় পাকিস্তানি সেনারা। শহরজুড়ে মাইকে প্রচারণা চালিয়ে মানুষজনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ১২ নভেম্বর (শুক্রবার) বেলা ১১টার দিকে পাকিস্তানি সেনারা তার হাত বেঁধে তাকে ক্যাম্পে থাকা বাঘের খাঁচায় ছেড়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে একটি বাঘ এক পলকেই সালাহউদ্দিনের বুক ও মুখে থাবা বসিয়ে দিল। সালাহউদ্দিন ‘মা, মা...’ বলে চিৎকার দিতেই খাঁচার দুটি বাঘ মিলে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে লাগল তার দেহ। আর এ দৃশ্য দেখে উপস্থিত রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা উল্লাস করতে লাগল।
সালাহউদ্দিনের চাচাতো ভাই মো. ওহিদুজ্জামান বলেন, ‘বিশ্বের ইতিহাসে কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে এভাবে হত্যার বর্বরতা আর আছে কি না তা আমার জানা নেই। এ ঘটনা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক নির্মম ঘটনা। দেশের স্বাধীনতার জন্য সালাহউদ্দিন বাঘের খাঁচায় নিজের জীবন উৎসর্গ করলেও আজ সে ঘটনার খুব একটা আলোচনা নেই। বাঘের খাঁচায় সালাহউদ্দিনের জীবন উৎসর্গের ঘটনাটি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তি এবং ১২ নভেম্বর শহীদ সালাহউদ্দিন দিবস হিসেবে ঘোষণার দাবি জানাচ্ছি।
মন্তব্য করুন