সোমবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৬ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

একাত্তরে বিদেশি সাংবাদিকদের বলিষ্ঠ ভূমিকা

এমএইচ মোবারক
১৭ নভেম্বর ২০২০ ০৫:৩১ |আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ ১২:৪৩
এমএইচ মোবারক, জন-সংযোগ কর্মকর্তা, উত্তরা ইউনিভার্সিটি
এমএইচ মোবারক, জন-সংযোগ কর্মকর্তা, উত্তরা ইউনিভার্সিটি

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি সাংবাদিক ও বিদেশি গণমাধ্যম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন, যা বিশ্বজনমত গঠনে সহায়তা করে। তাছাড়া পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, নৃশংস বর্বরতা, ধ্বংসযজ্ঞ, শরণার্থীদের দুর্ভোগ বহির্বিশ্বে তুলে ধরায় বিশ্ববাসী মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ঘটনা জানতে পেরেছে। এতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ত্বরান্বিত হয়েছে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের পর বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলো বুঝতে পারে, একটা কিছু হতে চলেছে। তাই তারা তাদের সাংবাদিকদের বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান) পাঠাতে শুরু করে। তাদের বেশির ভাগই ২৫ মার্চ অবস্থান নেন তৎকালীন শাহবাগের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। তাদের মধ্যে ছিলেন আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন, জাপানের প্রায় ৩৭ জন সাংবাদিক।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আকস্মিক ঝাঁপিয়ে পড়ে পাক হানাদার বাহিনী। সেই রাতে পিলখানা, রাজারবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পুরো ঢাকা শহরে রাতের নির্জনতা ভেঙে হানাদার বাহিনী সর্বকালের নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করেছিল। এ ঘটনা এতটাই পরিকল্পিত ছিল যে সেদিন ঢাকায় অবস্থানরত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সাংবাদিকদেরও জানতে দেওয়া হয়নি। তারা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অনেকটাই বন্দী অবস্থায় ছিলেন। তবে কেউ কেউ এর মধ্যেও চেষ্টা করেছেন সেই ভয়াল রাতের ঘটনা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে। ঢাকায় অবস্থানরত অকুতোভয় বিদেশি সাংবাদিকদের অনেকে নিজের জীবন বিপন্ন হতে পারে জেনেও ঘুরে ঘুরে সংবাদ সংগ্রহ করে বিশ্বজনমত তৈরিতে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। তারা ছবিসহ খবর সংগ্রহ করে বিদেশগামী প্লেনের বিভিন্ন যাত্রীর মাধ্যমে নিজ নিজ দেশের পত্রিকায় পাঠিয়ে দেন। তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

সিডনি এইচ শ্যানবার্গ

নিউইয়র্ক টাইমসের সিডনি এইচ শ্যানবার্গ তেমনই একজন, যিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাক হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা এবং মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছেন। সে সময় তিনি নিউইয়র্ক টাইমসের দিল্লি প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর দেশের উপকূলীয় এলাকায় ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে লাখ লাখ মানুষের জীবনহানীসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সংবাদ সংগ্রহ করতে সেসময় তিনি পূর্বপাকিস্তান সফর করেন। সে বছর ডিসেম্বরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয়, ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সংলাপ খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনি। সেই সূত্রে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে যে কজন বিদেশি সাংবাদিক পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা প্রত্যক্ষ করেন, শ্যানবার্গ ছিলেন তার অন্যতম। ১৬ ডিসেম্বর, ঢাকার রেসকোর্সে যেদিন জেনারেল নিয়াজি বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করেন, সেদিনও শ্যানবার্গ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতির বিজয় অর্জন পর্যন্ত পূর্বাপর পুরো ঘটনার অন্যতম সাক্ষী ছিলেন শ্যানবার্গ। মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ সময়ে নিউইয়র্ক টাইসে শ্যানবার্গের অসংখ্য প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। কোনোটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থেকে, কোনোটি দিল্লি বা কলকাতা থেকে। ভারত-বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্তে উদ্বাস্তু শিবিরে বহুবার গিয়েছেন। উদ্বাস্তুদের সঙ্গে কথা বলে তদের অবর্ণনীয় দুর্দশার বিবরণ তার প্রতিবেদনে উঠে আসতো। পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলাকালে জুন মাসের মাঝামাঝি পাকিস্তানি সেনারা হঠাৎ ঠিক করে পুরো দেশ তাদের নিয়ন্ত্রণে নিলো, সে তথ্য প্রমাণ করার জন্য কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিককে তাদের প্রহরায় দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাবে। শ্যানবার্গও ছিলেন তাদের একজন। সেই সফর শেষে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত তার প্রতিবেদনে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যার এক ভয়াবহ চিত্র ফুটে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্যানবার্গের ছিল অকৃত্রিম শ্রদ্ধা। ২৫ মার্চের আগে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার খবর নিতে সরাসরি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার বহুবার যোগাযোগ হয়েছে। সেই যোগাযোগ একসময় বন্ধুত্বে পরিণত হয়। এছাড়া দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিশ্ব নেতৃবৃন্দের চাপে পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ঢাকা ফেরার পথে বঙ্গবন্ধু দিল্লিতে স্বল্প সময়ের জন্য যাত্রাবিরতি করেছিলেন। শ্যানবার্গ সেদিন এয়ারপোর্টে ছিলেন। অনেক দূর থেকে তাকে দেখে বঙ্গবন্ধু চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘আরে শ্যানবার্গ, তুমি?’ যেন দুই পুরোনো বন্ধু, এমনভাবে তারা সেদিন করমর্দন করেছিলেন।

১৬ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও মিরপুরের কোনো কোনো এলাকায় তখনো কিছু পাকসেনা স্থানীয় বিহারীদের সঙ্গে মিলে বাঙালি নিধন করছিল। এরমধ্যেই ১৮ ডিসেম্বর শ্যানবার্গ গিয়েছিলেন মিরপুরের এক গণকবরে। সেখানে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা লাভ করেন তিনি। এ প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে শ্যানবার্গ বলেন, ‘মিরপুরের একটি গণকবরে ১২-১৩ বছরের একটি বালকের সঙ্গে দেখা। অপুষ্টি ও অভাবে শীর্ণ শরীর। মাটি খুঁড়ে বানানো বেশ প্রশস্ত গণকবরটির চতুর্দিকে ছুটে বেড়াচ্ছিল ছেলেটি। হঠাৎ দেখলে মনে হবে খেলা করছে, দৌঁড়ে দৌঁড়ে ছুটছে, হাতে ছোট একটি খুরপি দিয়ে মাটি খোঁচাচ্ছে। অধিকাংশ কবর সদ্য তৈরি, মাটি তখনো জমাট বাঁধেনি। মাটিতে হাত ডোবালেই বেরিয়ে আসছিল সদ্য মৃত মানুষের দেহাবশেষ। এই ভুতুড়ে জায়গায় এই ছেলেটি কেন? আর কেনই বা এমন করছে সে? এরপর দোভাষীর কাছ থেকে জানতে পারি, বাবার লাশ খুঁজছে ছেলেটি। সেই ছেলেটিকে আমি এখনো দেখতে পাই, চোখ বুজলেই তার মুখটা ভেসে ওঠে।’

ছোট কয়েকটি কথায় সেদিন মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর নৃশংসতাকে তিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন।  একাত্তরের ঘাতকদের বিচারে যদি সাহায্য দরকার হয়, নিজের অভিজ্ঞতার বিবরণ নিয়ে সাক্ষী হতে তিনি প্রস্তুত ছিলেন। তার এক লেখায় লেখায় তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে আমার অভিজ্ঞতা আমার জন্য এখনো গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম একাত্তরের গণহত্যা ভালোভাবে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়নি, সে জন্য আমি সে ঘটনা যতটা সম্ভব সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ আমার নিজের দায়িত্ব বলে মনে করি। আমি শেখ মুজিবের নেতৃত্ব ও সাহসিকতার জন্য তাকে সম্মান করি। ১৯৭১-এ আমার সরকার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অপরাধমূলক ব্যবহারের প্রতি যে সমর্থন দেয়, সে জন্য আমি ঘৃণা বোধ করি।’

তিনি তার লেখা ‘বিয়ন্ড দ্য কিলিং ফিল্ডস’ গ্রন্থে সে সময়ের ১২টি প্রতিবেদন অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি পুরো যুদ্ধকালে মুক্তিযুদ্ধের ওপর অসংখ্য প্রতিবেদন পাঠান যার অধিকাংশ ছিল শরণার্থী বিষয়ক। তার প্রতিবেদনে পুরো বিশ্ব জানতে পারে পাক বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ এবং ভারতে অবস্থিত শরণার্থীদের অবস্থা। তার অসংখ্য প্রতিবেদনের একটি নির্বাচিত সংকলন প্রকাশ করেছে ঢাকার সাহিত্য প্রকাশ। নাম ডেটলাইন বাংলাদেশ-নাইন্টিন সেভেন্টিন ওয়ান। অনুবাদ ও সংকলন করেছেন মফিদুল হক।

সিডনি শ্যানবার্গ ১৯৩৪ সালের ১৭ জানুয়ারি আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৯ সালে তিনি দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে যোগ দেন। দীর্ঘদিন রোগশয্যায় থেকে ৮২ বছর বয়সে ২০১৬ সালের ৯ জুলাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মহান বন্ধু সিডনি শ্যানবার্গ মারা যান।

লেয়ার লেভিন

১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পক্ষে নিপীড়িত বাঙালির পক্ষে যেসব বিদেশি সাংবাদিকগণ জীবনের মায়া ত্যাগ করে ছবি তুলেছেন এবং তাদের ছবি বিদেশি গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার হয়েছিল তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন লেয়ার লেভিন। আমেরিকান একজন চলচ্চিত্র পরিচালক ও আলোকচিত্র শিল্পী। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যুদ্ধ চলাকালে কিছু দুর্লভ চিত্রধারণ করেছিলেন। চলচ্চিত্র পরিচালক ও আলোকচিত্র শিল্পী লেয়ার লেভিন, যিনি ১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পর ছুটে এসেছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। বাঙালিদের উপর তখন থেকেই তার একটা মায়া লেগে যায়। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর একদিন তিনি তার উকিল মর্টেন হ্যামবার্গ-এর কাছ থেকে জানতে পারেন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও শরণার্থীদের দুর্দশার কথা। এরই মধ্য নিউইয়র্ককে ১ আগস্ট ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ তাকে অনুপ্রাণিত করে।

উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য সচেতনতা এবং ত্রাণ তহবিল বাড়ানোসহ পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর নৃশংসতার খবর বিশ্বের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রচেষ্টায় অনুষ্ঠিত ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ এখন ইতিহাসের একটি অংশ। এতে অংশ নিয়েছিলেন জর্জ হ্যারিসন, ওস্তাদ রবি শঙ্কর, বব ডিলান, লিয়ন রাসেল, রিঙ্গো স্টার, ওস্তাদ আলী আকবর খান, ওস্তাদ আল্লা রাক্ষা, বিলি পিস্টনের মতো খ্যাতিমান সব শিল্পীরা। লেয়ার লেভিন তাদের প্রায় সকলকে চিনতেন। কেননা তিনি তখন শর্ট ফিল্ম, ডকুমেন্টারি বানানোর পেশা ও নেশায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭১ সালে লেয়ার লেভিন ও তার স্ত্রী তাদের প্রথম সন্তানকে বরণ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন। তারপরও তিনি চুপচাপ বসে থাকতে পারলেন না। স্ত্রীকে একা রেখে চলে এসেছিলেন পশ্চিম বাংলায়। বাঙালিদের কথা সেলুলয়েডে ধারণ করার জন্য দুই মাস অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন। এভাবে কাজের মধ্যে ডুবে থেকেই একদিন লেয়ার লেভিন ‘বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’র ট্রাকটি দেখে ফেলেন এবং সেইদিন থেকেই তিনি এই গানের দলের সঙ্গে ঘুরতে থাকেন শরণার্থী ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে।

অক্লান্ত পরিশ্রমী এই আলোকচিত্র শিল্পী ১০ নভেম্বর ১৯৭১ তার ত্রিশ তম জন্মদিন পালন করেন গোলাবারুদের গন্ধের ভেতর বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। ‘বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’র শিল্পীবৃন্দের গানগুলো যে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নিচ্ছে, সেদিন হয়তো তিনি এতটা বুঝতে পারেননি। তবুও যারা মানব প্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন তারা ভালো করেই বুঝতে পারেন অতীতের দিনগুলো ফিরে দেখার মধ্যে কতটা ভালোবাসা কতটা আবেগ লুকিয়ে থাকে, আর সেটা যদি হয় ইতিহাস লিখনের সময়! তাই হয়তো তিনি মুক্ত হবার অদম্য শক্তির ভাষা তুলে যেতে লাগলেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এমন সৃষ্টিশীল কাজের সঙ্গে যারা জড়িত থাকেন তাদের থাকে দুটি প্রত্যাশা। প্রথমত, তাৎক্ষণিক মনোযোগ আদায়ের জন্য এই শৈল্পিক সৃষ্টিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা; দ্বিতীয়ত, অতীতের বাতিঘর নিখুঁতভাবে জ্বালিয়ে রাখা, যাতে বর্তমানে দাঁড়িয়ে আলোকিত হবার অভাব না থাকে।

লেভিনের আশা ছিল, পাকিস্তানিদের সহিংসতার কথা আমেরিকাবাসীদের জানাতে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করা। যা কিনা প্রথম প্রত্যাশা মেটানোর কাজ হতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্য বা যোগান না পাওয়াতে লেয়ার লেভিনের ২২ ঘণ্টার ধারণকৃত ফুটেজ পড়ে থাকলো তার বাড়ির বেসমেন্টে। স্বাধীনতার বহু পরে মাহমুদুর রহমান বেণুর কাছ থেকে তারেক মাসুদ জানতে পারেন লেয়ার লেভিনের কথা। তারপর থেকেই শুরু হয় লেভিনকে খোঁজার পালা। অবশেষে ১৯৯০ সালে আসে সেই শুভক্ষণ। তারেক মাসুদ ও তার স্ত্রী ক্যাথরিন গিয়ে সরাসরি হানা দেন লেয়ার লেভিনের বাড়িতে। মূলত ক্যাথরিন মাসুদই লেয়ার লেভিনকে রাজি করিয়ে এবং প্রয়োজনীয় চুক্তি সই করে ২০ বছর পর উদ্ধার করে আনেন মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল। তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় তাদের কাজ। আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় এক অবিস্মরণীয় কীর্তি ‘মুক্তির গান’-এ।

তিনি তার ক্যামেরায় ধারণকৃত বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধ, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, নারী নির্যাতনসহ অসংখ্য যুদ্ধের ছবি বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাঠিয়েছেন। যা বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমগুলোতে ফলাও করে ছাপা হয়েছে। লেয়ার লেভিনের দুঃসাহসী কাজ আমাদেরকে আজও অনুপ্রাণিত করে।

উপেন তরফদার

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আকাশবাণীর ‘সংবাদ বিচিত্রা’ বিভাগের প্রযোজক ছিলেন উপেন তরফদার। সে সময় মুক্তিযুদ্ধের খবর আকাশবাণীতে প্রচার করাই ছিল তার ধ্যান। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের খবর সংগ্রহে তিনি বারবার ছুটে গিয়েছেন রণাঙ্গনে। কর্মজীবনের উজ্জ্বলতম সময় ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ— এমনটাই বলতেন তিনি। মুজিবনগরে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানেও উপস্থিত ছিলেন তিনি। যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের দিনও উপস্থিত থেকে খবর সংগ্রহ করেছেন।

১৯৩৬ সালে বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ জেলার নালি গ্রামে জন্ম উপেন তরফদারের। ১২ বছর বয়সে তিনি চলে যান কলকাতায়। কলকাতায় পড়াশোনা করেছেন। ১৯৫৪ সালে তিনি যোগ দেন আকাশবাণীতে। দীর্ঘ ৪০ বছর আকাশবাণী ও দূরদর্শনে কাজ করেছেন তিনি। আকাশবাণীর শিলিগুড়ি কেন্দ্রের স্টেশন ডিরেক্টর ছিলেন। এ ছাড়া দূরদর্শনের কলকাতা স্টেশনের ডেপুটি ডিরেক্টর পদে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার উপেন তরফদারকে সম্মাননা দিয়েছেন। তিনি ১৪ জানুয়ারি, ২০২০-এ কলকাতার পিজি হাসপাতালে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

রঘু রায়

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ফ্রেমবন্দী করার দুঃসাধ্য কাজটি করেছিলেন দুঃসাহসিক আলোকচিত্র শিল্পী রঘু রায়। তার তোলা ছবিগুলোতে তিনি এক অসামান্য মহাকাব্য করে গড়ে তুলেছিলেন। সৃষ্টি করতে পারঙ্গম খুব কম ফটোগ্রাফারই। ছবির সিরিজ দিয়ে গল্প তৈরি করার তেমন প্রয়োজন হয়নি রঘু রায়ের। তার একেকটা ছবিই একেকটা গল্প। একটি ছবি যে কত গল্প বলে যায়, যা ছবিতে আছে, যা নেই। রঘু রায়ের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ছবি যেন একেকটা ছোট গল্প। অগণিত লাশের মিছিল আর সম্ভ্রম হারানো লাখো বীরমাতার রক্তাক্ত শরীরের বিনিময় অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ও অশ্রুজলের ছোঁয়া দিয়ে ১৯৭১ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ছবি তুলেছেন ভারতের ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকার তরুণ আলোকচিত্রী রঘু রায়। ৫ মাস তিনি ভারত ও তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন সীমান্তে ছুটে বেড়িয়েছিলেন এসব ছবির জন্য। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর হারিয়ে যায় ছবিগুলোর নেগেটিভ। বহু বছর পর তিনি খুঁজে পান নেগেটিভগুলো। তার সেই ছবিগুলো নিয়ে প্রদর্শনী হয় স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে। শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশ : দ্য প্রাইজ অব ফ্রিডম’ বা ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল্য’। রঘু রায় দুইটি ভাগে বিভক্ত করেছেন প্রদর্শনীর ছবিগুলোকে ‘শরণার্থী’ ও ‘বিজয়ের পর’।

ছবিগুলো প্রসঙ্গে রঘু রায় বলেন, ১৯৭১ সালে আমার বয়স ২৮ বছর। স্টেটসম্যান পত্রিকার কর্তৃপক্ষ মাত্র ৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আমাকে সীমান্তবর্তী এলাকার পরিস্থিতির ছবি তুলতে পাঠানো হয়। সেখানে আমি মূলত নারী ও শিশুদের ছবি বেশি তুলি। আমি তাদের দুঃখ-দুর্দশা দেখে এক সময় পাগলের মতো হয়ে পড়ি। এভাবে কী মানুষ বেঁচে থাকতে পারে।’

তার তোলা আলোচিত একটি ছবি অশ্রুসিক্ত ক্ষুধার্থ এক শিশুর কান্না। ছবিটি প্রসঙ্গে রঘু রায় বলেছিলেন, এই ছবিটি সে সময় আমার ছেলে দেখে। তখন তার বয়স মাত্র তিন। সে অবর্ণনীয় কষ্টের ছবি দুইটি দেখে অশ্রুসজল চোখে আমাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘বাবা, ওরা কাঁদছে কেন?।’ সে সময় আমি কোনো জবাব দিতে পারিনি। এখন আমি বলতে পারি, ওরা নিজ দেশের স্বাধীনতার মূল্য দিতে গিয়ে কাঁদছিল। তার তোলা সব ছবিই সাদাকালো। ছবিগুলো দেখতে দেখতে মনের ভিতর এ ধারণা জন্মাতেই পারে সেই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ভিতর দিয়ে চলেছেন আপনিও।

দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়ের নামটি অক্ষয় হয়ে আছে এবং যতদিন বাংলাদেশ রয়েছে ততদিন থাকবে। পাকিস্তানি বাহিনী যখন নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছিল, তখন এ দেশের মানুষ উৎকর্ণ হয়ে শুনতে চাইত আশার বাণী। খুঁজত আশার আলো। দিনে বা রাতে যখন খবর প্রচারিত হতো স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র, আকাশবাণী কিংবা বিবিসি থেকে, মুক্তিকামী মানুষ অতিগোপনে শুনত তা। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় খবর পড়তেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আকাশবাণীতে। ‘আকাশবাণী কলকাতা, খবর পড়ছি দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়’—ভরাট কণ্ঠের এই সম্ভাষণ বাংলাদেশের মানুষকে আশ্বস্ত করত। তার আবেগভরা কণ্ঠস্বর আশাজাগানিয়া হয়ে ওঠে যুদ্ধরত বাঙালিদের কাছে। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে উজাড় করে দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন শব্দসংগ্রামী হয়ে উঠেছিলেন। কোটি মানুষের আগ্রহের একটি বিন্দু হয়ে উঠেছিলেন তিনি। ভারী কণ্ঠস্বর ও অনবদ্য বাচনভঙ্গি দিয়ে শ্রোতাদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধের খবর পড়তে পড়তেই বাংলাদেশের সঙ্গে গড়ে ওঠে তার নিবিড় সম্পর্ক। তিনি বলতেন, ‘বাংলাদেশ আমার দ্বিতীয় স্বদেশ।’ মানতেন, তার পেশাগত জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়টা। আকাশবাণীর সংবাদ বা সংবাদ পরিক্রমা অথবা সংবাদ সমীক্ষা পড়তেন যখন, মনে হতো তিনি নিজেই আছেন রণাঙ্গনে। মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো সফল অপারেশনের খবর পড়ার সময় তার কণ্ঠেও নেমে আসত উচ্ছ্বাস। করুণ কোনো হত্যাযজ্ঞের খবর পড়তে গিয়ে আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়ত তাঁর স্বর। বাংলার মানুষ সেই কণ্ঠস্বর শোনার জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকত। তখনো বাংলাদেশ দেখেননি দেবদুলাল।

এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘একাত্তর কেন, সেই ৬৯-এর গণ–অভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোতেও পড়েছি বাংলাদেশের খবর। তখন কে জানত, এই অভ্যুত্থানের পথ বেয়ে বাংলাদেশ হবে বাঙালিদের একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র! পৃথিবীর বুকে বাঙালিদের জন্য তৈরি হবে একটি স্বাধীন আবাসভূমি।’ তিনি বলেছিলেন, ‘অদেখা পূর্ববঙ্গের অচেনা বঙ্গভাষীদের প্রতি নৈকট্যবোধে আমার মন আপ্লুত হয়েছে বারবার। আর কল্পনায় গড়ে তুলেছিলাম বাংলাদেশ নামের একটি মানসী মূর্তিকে।’

বাংলাদেশ স্বাধীন হলে দেবদুলাল বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে প্রথম বাংলাদেশে এসেছিলেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরলে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বঙ্গবন্ধু তাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। ১৯৭২ সালে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্মান পদ্মশ্রী পান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানেরই স্বীকৃতি ছিল তা। ১৯৩৪ সালে নদীয়ার শান্তিপুরে দেবদুলালের জন্ম। ২০১১ সালের ২ জুন তিনি ইহলোক ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমান।

পঙ্কজ সাহা

মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও (আকাশবাণী)’ এর প্রখ্যাত সাংবাদিক, আন্তর্জাতিক মিডিয়া-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব (কলকাতা দুরদর্শন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক), প্রথিতযশা কবি ও লেখক ‘পঙ্কজ সাহা’ ১৯৪৬ সালের ১২ মে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের হুজরাপুর মহল্লার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা প্রয়াত মনিন্দ্রনাথ সাহা এবং মাতা প্রয়াত চঞ্চলা সাহা (ইলা সাহা)। ৫০ এর দশকে তার পিতা মনিন্দ্রনাথ সাহা স্বপরিবারে কলকাতায় চলে গেলেও ছেলেবেলায় প্রায়ই তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জে এসে থাকতেন। শৈশব-কৈশোরের অনেকটা সময় তার কেটেছে জন্মভূমি চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি ছিলেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও (আকাশবাণী, কলকাতা)’ এর সাংবাদিক। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পক্ষে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও (আকাশবাণী)’ এর সংবাদসংগ্রহ এবং বঙ্গবন্ধু-মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বিভিন্ন রেডিও প্রোগ্রাম করে মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন প্রখ্যাত সাংবাদিক ‘পঙ্কজ সাহা’। সেই সময় মুক্তিযোদ্ধাসহ কলকাতায় আশ্রয়রত শরণার্থীদের বিভিন্ন প্রকার সহযোগিতা করেন তিনি। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সাবেক মহামান্য রাষ্ট্রপতি ‘প্রয়াত জিল্লুর রহমান’ এবং বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ‘শেখ হাসিনা’ একসঙ্গে ‘পঙ্কজ সাহার’ হাতে তুলে দেন ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা-পদক’।

সায়মন ড্রিং

কলম আর ক্যামেরা হাতে নিজের জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে নিরীহ বাংলাদেশিদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন সাংবাদিক সায়মন ড্রিং। একাত্তর সালে সাইমন ড্রিংয়ের বয়স ছিল মাত্র ২৭ বছর। তিনি তখন নামকরা পত্রিকা ডেইলি টেলিগ্রাফের একজন সাংবাদিক। তখন আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পাকিস্তানি সামরিক সরকার ২৫ মার্চ বিশ্বের বড় বড় সংবাদমাধ্যমগুলোর ৪০ জন সাংবাদিককে বাংলাদেশে আসার অনুমতি দিয়েছে। সেই সুযোগে টেলিগ্রাফের সাংবাদিক হিসেবে বাংলাদেশে এলেন সায়মন ড্রিং। ১৯৭১ সাল। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছে তত্কালীন পূর্ব-পাকিস্তানের নিরস্ত্র জনগণের ওপর। ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হলো। চারদিকে মৃত্যুর বিভীষিকা। একসময় সাংবাদিকদের জন্য অবস্থা প্রতিকূলে চলে গেলে তিনি দেশ ত্যাগ না করে লুকিয়ে থাকেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ উঠে গেলে হোটেলের কর্মচারীদের সহযোগিতায় ছোট একটি মোটরভ্যানে করে ঘুরে ঘুরে দেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল, রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা। ঢাকার বুকে তখন হত্যা, ধ্বংস আর লুটপাটের চিহ্ন। কিন্তু পুরো বিশ্ববাসী তখনো অন্ধকারে। পর্যাপ্ত ছবি আর প্রত্যক্ষ ছবিগুলো নিয়ে তিনি পালিয়ে চলে গেলেন ব্যাংককে। আর সেখান থেকে প্রকাশ করলেন ‘ট্যাংকস ক্রাশ রিভল্ট ইন পাকিস্তান’। শেষ পর্যন্ত এ নিধনযজ্ঞের কথা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সায়মন ড্রিং। পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতনের চিত্র তিনি তুলে ধরেন বিশ্ববাসীর সামনে। তার পাঠানো খবরেই নড়েচড়ে বসল পুরো বিশ্ব।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং পাকবাহিনীর গণহত্যার সংবাদ বিশ্ববাসীর সামনে প্রচারে অনন্য ভূমিকা পালনকারী ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশনের (বিবিসি) বিশিষ্ট সাংবাদিক মার্ক টালি। একাত্তরের বিবিসি বলতে তত্কালীন সবাই মার্ক টালিকেই জানত। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রেডিওর এরিয়াল তুলে শর্টওয়েভ স্টেশনের নব ঘুরিয়ে স্থির হয়ে সকাল-সন্ধ্যা বিবিসিতে কী বলছেন মার্ক টালি, তা শোনার জন্য উত্কণ্ঠিত থাকত পুরো দেশ। নিত্যদিনের প্রাণবন্ত খবরের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে হাজির হতেন মার্ক টালি। একদিন বাংলাদেশে স্বাধীন হলো। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া উপহার পেয়ে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন সাংবাদিক স্যার উইলিয়াম মার্ক টালি। এ বিরল উপহারটিকে তিনি তার জীবনের মহামূল্যবান সম্পদ হিসেবে উল্লেখ করেন।

বিদেশি আলোকচিত্রীর মধ্যে রয়েছেন জার্মান ফটোগ্রাফার থমাস বিলহার্ডট, হর্স্ট ফাস; আমেরিকান ফটোগ্রাফার ডেভিড কেননারলি, ডেভিড বার্নেট, মেরি এলেন মার্ক, ডিক ডুরান্স; ব্রিটিশ ফটোগ্রাফার উইলিয়াম লাভলেইস, ডর ম্যাকক্যালিন, ক্রিস পার্কিনস, জন ডাউনিং, মার্ক এডওয়ার্ডস, মেরিলিন সিলভারস্টোন; সুইডিশ ফটোগ্রাফার বো কার্লসন, আফ্রো-ইউরোপিয়ান ফটোগ্রাফার ডেনিস নিল্ড, ফ্রেঞ্চ ফটোগ্রাফার মাইকেল লরেন্ট, মার্ক রিবৌদ, ক্রিশ্চিয়ান সিমোনপিয়েত্রি, রেমন্ড ডেপার্ডন, ব্রুনো বার্বে, আব্বাস আত্তার; ভারতে রঘু রায়, কিশোর পারেখ, অমিয় তরফদার, বালকৃষ্ণা, রবীন সেনগুপ্ত, সন্তোষ বসাক ও মানবেন্দ্র মণ্ডল। স্টেটম্যান পত্রিকার মানস ঘোষসহ নাম না জানা অনেক সাংবাদিক বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন, যা বাঙালি জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে আজীবন স্মরণ করবে।


লেখক: এমএইচ মোবারক, কবি-সাংবাদিক ও শিক্ষা কর্মকর্তা।


আরও পড়ুন-

কেন কিছু মানুষের ওজন কখনো বাড়ে না
যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে এত সম্পদ!
করোনা প্রতিরোধে ৯৫ শতাংশ কার্যকর ভ্যাকসিন
গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা এবং প্রাসঙ্গিক কথা



মন্তব্য করুন