শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ৭ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যুদ্ধশিশু : এই সমাজ যাদের ধারণ করতে পারেনি

রাফিয়া মাহমুদ প্রাত
১ ডিসেম্বর ২০২০ ১৯:২৩ |আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ ১৩:৫৮
যুদ্ধশিশু, ছবি : সংগৃহীত
যুদ্ধশিশু, ছবি : সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে বই, সিনেমা, ডকুমেনটারি, পোস্টার কোনো কিছুর কোনো কমতি নেই আজ আমাদের। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ইতিহাসকে চিরঞ্জীব রাখতে আমাদের চেষ্টারও নেই কোনো গাফিলতি। আজকাল সব আয়োজনেই মুক্তিযুদ্ধকে স্মরণ করা হয়।

শুধু স্মরণ করা হয় না আমাদের যুদ্ধশিশুদের, পরিত্যক্ত, অনাথ শিশুদেরবীরাঙ্গনাদের নিয়ে দু-চারটি জায়গায় আয়োজন হলেও যুদ্ধশিশুরা রয়ে গেছে ইতিহাসের আঁধারে যুদ্ধশিশুদের নিয়ে নেই কোনো উদযাপন, আয়োজন বা শোকগাঁথা। না আছে কোনো তথ্য-উপাত্ত বা পরিসংখ্যান। পরবর্তীতে যতটুকু যা করা হয়েছে তাকেও নির্ভুল, সঠিক বলে দাবি করা যাবে না। অথচ এই যুদ্ধের ৯ মাস পাক সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে নির্বিচারে যে যৌনাচার চলেছিল এবং তার ফলশ্রুতিতে যে সকল যুদ্ধশিশুদের জন্ম হয় তাদের জন্ম, জীবন আমাদের ইতিহাসের এক বৃহৎ তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায় হতে পারতো।

যুদ্ধশিশু কারা?

পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক বাঙালি নারীদের উপর ধর্ষণের ফলশ্রুতিতে তাদের গর্ভে যেসব সন্তানের জন্ম হয় সেসকল শিশুকেই যুদ্ধশিশু বলা হয়। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ নাগাদ পাকিস্তানি সেনারা সকলে আত্মসমর্পণ করে ভারতে চলে যায়। শিশুদের জন্মদাত্রী মায়েরাও নাম পরিচয়হীনতায় হারিয়ে যায়। এসব শিশুদের সমাজ ‘জারজ সন্তান’, ‘অবৈধ সন্তান’, ‘শত্রু সন্তান’ রূপে গণ্য করতো। তাদের জন্মদাত্রী মায়েরাও এই অবজ্ঞা থেকে রেহাই পেতো না। সমাজ কলঙ্কের ভয়ে তাই এইসকল মায়েরা অন্যত্র গিয়ে সন্তানের জন্ম দিতেন। এমনকি এই অভিশাপ থেকে বাঁচার জন্য আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে অনেকে। যেহেতু এসব মায়েরা গর্ভধারণে মোটেই ইচ্ছুক ছিলো না তাই নবজাতকেরা সমাজে অপাংক্তেয় হয়ে পড়ে।

তখন বেশ কিছু মিশনারিজ সংগঠন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। তাদের সহায়তায় বাংলাদেশ থেকে বিশাল সংখ্যক যুদ্ধশিশু বিদেশে পাড়ি জমায়। তবে এই দত্তক নেওয়ার ব্যাপারে প্রথম আগ্রহ প্রকাশ করে কানাডা। বাংলাপিডিয়ার তথ্যা অনুযায়ী মাদার তেরেসা ও তার মিশনারিজ অব চ্যারিটির সহকর্মীদের প্রচেষ্টায় এবং বাংলাদেশের শ্রম ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে নিচের দুটি কানাডীয় সংগঠন দত্তক গ্রহণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়।

·       ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন

·       কুয়ান-ইন-ফাউন্ডেশন

যুদ্ধশিশু, ছবি : সংগৃহীত

পরবর্তীতে ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন ও অস্ট্রেলিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশ এ উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয়। ১৫ জন শিশুর প্রথম দলটি কানাডায় যায় ১৯৭২ সালে। এরপর অন্যান্য দেশেও পাঠানো হয় এসব যুদ্ধশিশুদের। তবে সে সম্পর্কে সঠিক পরিসংখ্যান একপ্রকার দুর্লভ।   

তবে সরকারি দপ্তর, এনজিওর রেকর্ডপত্র, দেশি বিদেশি মিশনারিজ সংস্থাগুলোর নথিপত্রে সীমিত আকারে হলেও কিছু দলিল আছে যা থেকে প্রকৃত সংখ্যা বা তথ্য না জানলেও ধারণা করা যায়। যেমন একটি ইতালীয় চিকিৎসক দলের সমীক্ষা অনুযায়ী যুদ্ধশিশু জন্মদানকারী মায়ের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। আবার লন্ডন ভিত্তিক এক সংস্থার (আইপিপিএফ) হিসাব অনুযায়ী এর সংখ্যা ২ লাখ। সরকারি হিসেবে ৩ লাখ। যুদ্ধশিশুদের ব্যাবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত এক সমাজবিজ্ঞানীর মতে, এই সংখ্যা ২ লাখ।

অর্থাৎ এ বিষয়ক কোনো নির্ভরযোগ্য সমীক্ষা নেই। গবেষক মুস্তফা চৌধুরীর মতে, সঠিক দলিলাদি সংরক্ষণের অভাবে সঠিক তথ্যসমূহ পাওয়া দূর্লভ হয়ে পড়েছে। 

প্রকৃতপক্ষে, বিষয়টি ছিল খুব স্পর্শকাতর। তাই এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষা করার বিধান ছিলো। আর তাই কার গর্ভজাত সন্তান এটি যেমন প্রকাশে নিষেধ ছিল তেমনি সেসব শিশুর কোথায় কীভাবে কোন ধর্মে বেড়ে উঠছে সেই বিষয়েও ছিল গোপনীয়তা।

তবে পরিতাপের বিষয়, বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা এবং সুযোগ সুবিধা দেওয়ার কথা হলেও যুদ্ধশিশুরা এখনো আঁধারেই পড়ে রয়েছে। যুদ্ধশিশুদের নিয়ে এখনো কোনো উদ্যোগ মন্ত্রণালয় থেকে নেওয়া হয়নি।  

এই যুদ্ধশিশুদের নিয়ে গবেষণা করেছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মুস্তফা চৌধুরী। যুদ্ধশিশু নিয়ে তার গবেষণা গ্রন্থ ’৭১ এর যুদ্ধশিশু : অবিদিত ইতিহাস’যেখানে তিনি দত্তকগ্রাহী কানাডিয়ান বাবা-মা, যুদ্ধশিশু, তাদের বেড়ে ওঠা, আনন্দ বেদনা এইসবকিছুর বাস্তব চিত্র দেখিয়েছেন।


ছবি : প্রথম আলো

মুস্তফা চৌধুরী কানাডার সেসব যুদ্ধশিশুদের সাথে কথাও বলেছেন। তিনি তাদের সম্পর্কে বলেন, তারা ভালোই আছেন। তারা নিজেদের বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী কানাডীয়ান মনে করেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন এরই মধ্যে বাংলাদেশে তাদের জন্মদাত্রীর খোঁজে এসেছিলেন। কিন্তু তাদের দূর্ভাগ্য তারা তাদের মায়েদের খোঁজ পেতে ব্যর্থ হনকারণ নিয়মানুসারে জন্মদাত্রীর নাম পরিচয় লিপিবদ্ধ হয় না। হয় সন্তানের জন্ম তারিখ, নাম


 ছবি : ashrambd.com




 

 

কয়েকজন যুদ্ধশিশু
বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুদের মধ্যে প্রথম যে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন তিনি হলেন ‘রায়ান গুড’। বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুদের মধ্যে যে দলটিকে প্রথম কানাডায় দত্তক নেওয়া হয়েছিল তাদেরই একজন এই রায়ান। ১৯৮৯ সালে তিনি বাংলাদেশে আসেন। মাকে খুঁজতে তিনি প্রথমে পুরান ঢাকায় যান। যেখানে তার জন্ম হয়েছিলকিন্তু সেখানে কিছুই জানা সম্ভব হয়নি রায়ানেরশুধু জানতে পারেন যে তার মা ছিলেন বরিশালের মেয়ে। তাই তিনি ছুটে যান বরিশালেওকিন্তু সেখানেও না পেয়ে তিনি পরিশেষে কলকাতার মিশনারিজ অব চ্যারিটি কেন্দ্রে খোঁজ নিতে যানকিন্তু সেখানেও মায়ের খোঁজ পাননি রায়ান গুড    

মাকে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিলেও জন্মভূমির প্রতি টান তার বয়সের সাথে সাথে বাড়তে থাকে। তাই তিনি ১৯৯৮ সালে আবারও আসেন বাংলাদেশে। টানা এক বছর ছিলেন তিনি নিজ জন্মভূমিতে। পরবর্তীতে রায়ান বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার আকুতি জানান এবং পেয়েও যান। ২০০৩ সালে রেমন্ড প্রভশের নির্মিত  ‘ওয়ার বেবিজ’ প্রামান্যচিত্রে রায়ান গুড অন্যতম প্রধান চরিত্র।   

তবে রায়ানের মতো সুস্থ স্বাভাবিকভাবে জীবন যে সবাই পেয়েছে তা নয়। হয়তো পালক বাবা মায়ের অফুরন্ত আদর, স্নেহ ছিল, বিত্তবৈভবের মাঝে বেড়ে ওঠা সত্ত্বেও আত্মহত্যাকে বেছে নিয়েছে অনেকে। তেমন এক যুদ্ধশিশু রানী। জীবদ্দশায় রানী তার অন্তহীন বেদনার কথা লিখে গেছেন এভাবে-

 ত্যাগ করেছিলে তুমি আমাকে যখন আমি শিশু,/

কেন তা জানি না আমি, কখনো জানব না,/

কিন্তু তুমি সারাক্ষণ থাকবে মা আমার ভাবনায়,

ভালোবাসবোই জেনো,

রোজিনা হোজে হোগ আরেক যুদ্ধশিশু। রোজিনা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরে কখনোই বাংলাদেশের জন্য কোনো টান অনুভব করেননি। বরং বাংলাদেশে যে কয়দিন থেকেছেন তখন কানাডার কথাই তার মনে পড়েছে। সে তার পালক বাবা মাকে খুবই ভালোবাসে। হোজের মতে, তার সাথে তার বাবা-মায়ের (দত্তক গ্রহণকারী)  চেহারায় অনেক মিল। বড় হওয়ার পর তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তার জন্মদাত্রী মা নিরুপায় হয়েই তাকে  মাতৃসদনে রেখে গিয়েছিলেন।

রাজিবের জন্ম ১৯৭২ সালের ১ জুলাই ঢাকার শিশু ভবনে। রাজিবকে সেই প্রথম ১৫ জন শিশুর সঙ্গে কানাডার সিমসন পরিবারের জন্য পছন্দ করা হয়েছিল। রাজিব অন্য ছেলে মেয়েদের মতোই বড় হচ্ছি। কিন্তু ১৯৮৯ সালে রোগ নির্ণয়ে ধরা পড়ে যে রাজিব সিজোফ্রেনিয়া রোগে আক্রান্ত।

ডাক্তারি বিদ্যায় বলা হয়ে থাকে যে, আপন মাতৃত্বের প্রতি মায়ের যে প্রতিক্রিয়া বা মনোভাব সেটাই গর্ভস্থ শিশুর মনে প্রভাব ফেলে। আর রাজীবের মানসিক অবস্থার জন্য তার জন্মদাত্রী মায়ের গর্ভাবস্থাই দায়ী।

অপর একজন যুদ্ধশিশু কোহিনূরযিনি একজন বিখ্যাত নরওয়েজিয়ান সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে এখন পরিচিত। ২০১১ সালে তিনি বাংলাদেশে এসে ঘুরে যান। সেসময় গণমাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে জানান, নরওয়েতে শুধু তিনিই নন, আও একশোর মতো যুদ্ধশিশু বেড়ে উঠছে। যাদের জন্মস্থান বাংলাদেশ।

এছাড়া এখানে জন কয়েক যুদ্ধশিশুর উদ্ধৃতি তুলে ধরা হলো-

'I am not attached to Bangladesh at an emotional level.This can be explained most likely by my early departure from the country.Emotions are created by thoughts.And thoughts are sometimes the reflections produced by experience.In my case, I have no experience that I can recall about Bangladesh hence,there are no emotional reponses available for me to create an attachment for a country I don’t remember.'

                                                                                                      -Onil Mark Mowling

'In all these years.I have never really wondered about my past,my parents or a family I may have left behind in Bangladesh and I have never made any attempt to try to find them.'

                                                                                              -Lara Jarina Morris

'Knowing what I know about the circumstances of my conception and the time period,I have never felt the urge to meet or find my  “putative” father.I was told that given the war, it is most likely that he raped my birthmother.As for meeting or finding my birthmother, I’ve never felt an urgency.'                                                        -Shama Jameela Mollie Hartt  

গোপনীয়তার স্বার্থে দেশে দলিলপত্র সংরক্ষণে না থাকার কারণে এই বিষয়াদি সম্পর্কে খুব একটা জ্ঞান নেই সাধারণ মানুষের। তবে সরকার সম্প্রতি  ‘জাতীয় আর্কাইভ আইন -২০১৫’ প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। 

যুদ্ধশিশুদের নিয়ে আমাদের দেশে কখনোই তেমন কোনো আলোচনা বা সভা–সমাবেশ হয়নি। তবে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৪ সালে হবিগঞ্জের সৈয়দ মোহাম্মদ কায়াসারকে দেওয়া ফাঁসির রায়ে আন্তর্জাতিক  অপরাধ ট্রাইব্যুনাল একটি নির্দেশনা দিয়েছেন–

‘একাত্তরের যেসব নারী ধর্ষিত হয়েছেন এবং যুদ্ধশিশু হিসেবে যাদের জন্ম হয়েছে তারা আমাদের জাতীয় বীর।’

বাংলাদেশের নারীদের প্রতি এই ধর্ষণ, বলাৎকার ও বিকৃতকাম আচরণের এসব ঘটনাবলী আজ সকলে ভুলে যাওয়ার পথে। স্বাধীনতার অন্য সবকিছুর মাঝে যেন এই বিশাল অধ্যায়টি ইচ্ছাকৃতভাবে চাপা দেওয়া হয়েছে। যুদ্ধশিশু বাংলাদেশের জন্য এক অন্ধকার অধ্যায়। যার সম্পর্কে খুব কম মানুষই জানে বা জানার চেষ্টা করে। এমনকি আমরা কেউ জানিও না এই সকল যুদ্ধশিশুরা এখন কোথায় কীভাবে আছে! আমরা যেভাবে পারিনি এই দেশের বুকে তাদের ধারণ করতে ঠিক তেমনিভাবে পারিনি তাদের নির্মম ইতিহাসকে সমুন্নত রাখতে

এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে দূরে সরিয়ে রেখে আমরা আমাদের ইতিহাসের একাংশ অনালোকিত এবং আমাদের বোনদের ত্যাগকে অস্বীকারই করেছি কেবল। 

 

তথ্যসূত্র

মুস্তফা চৌধুরী, একাত্তরের যুদ্ধশিশু : অবিদিত ইতিহাস


আরও পড়ুন-

মুক্তিযুদ্ধ ও তৎকালীন ছাত্র সমাজের ভূমিকা

ইন্দিরা দেবী : রবীন্দ্রনাথের মানসসঙ্গী
বাংলাদেশের অর্থনীতির হালচাল : সফলতা বনাম ব্যর্থতা




মন্তব্য করুন