প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার : এক ভালোবাসার কাঙালের গল্প
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, ছবিসূত্র : i0.wp.com
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। যার নামের সাথে মিশে আছে বীরত্ব, সাহস, স্বদেশপ্রেম, গর্ব, আত্মত্যাগ, দৃঢ়তা। স্বদেশ মুক্তির দাবিতে সশস্ত্র বিপ্লবে অংশ নেওয়া প্রথম নারী আমাদের এই প্রীতিলতা। তাই তার প্রতি আমাদের রয়েছে অবর্ণনীয় সম্মান, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার
নারীদের উন্নয়নের জন্য স্বতন্ত্রভাবে কিছু করে যাননি ঠিকই। কিন্তু তিনি যা করে গেছেন
তা আরও সহস্রবছর আমাদের নারীদের হৃদয়ে সাহস যুগিয়ে যাবে। সামাজিক, অর্থনৈতিক কিংবা
শিক্ষার দিক দিয়ে নয় তিনি দেখিয়ে গেছেন নারীদের অন্য পরিচয়। আর তা হলো নারীদের
বিপ্লবী রূপ। তিনি দেখিয়েছেন নারীরা বিপ্লবীদের সেবা শুশ্রুষা নয় শুধু, তারা পারে দেশের
জন্য শত্রুদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। দিতে পারে প্রাণ বিসর্জনও।
তিনিই প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার যিনি ব্রিটিশ নরপশুদের হাত থেকে বাঁচতে পটাশিয়াম সায়ানাইড পান করেছিলেন। পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবে আক্রমণের পর বিষপানে আত্মাহুতি দেওয়া এই মানুষটি ইংরেজ নরপশুদের হাতে নিজের মৃত্যু পর্যন্ত হতে দেননি!
কিন্তু আজ আমরা জানবো অন্য এক প্রীতিলতাকে। যে প্রীতিলতা শুধু শত্রুদের ঘাতক নয় হয়েছিলেন ভালোবাসার কাঙালও। ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে যিনি ত্যাগ করেছিলেন জীবনের সব স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্খা। ভালোবাসা হারানোর কষ্ট যার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দুয়ার দিয়েছিল বন্ধ করে।
কৃষ্ণ-প্রীতি
প্রীতিলতা তখন বেথুন কলেজে দর্শন বিভাগে অনার্সের ছাত্রী। একদিন খবরের কাগজে প্রথম রামকৃষ্ণের নাম চোখে পড়ে প্রীতিলতার।
রামকৃষ্ণ বিশ্বাস তখন কারাগারে বন্দী। আলিপুরে জেলে মৃত্যুর দিন গুণছেন। চাঁদপুর স্টেশনে ক্রেইগকে হত্যা করতে গিয়ে তিনি তারিণী মুখার্জিকে হত্যা করেন এবং ধরা পড়ে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত হন। একজন নির্ভীক মৃত্যুপথযাত্রী এই বিপ্লবীর সাথে দেখা করতে প্রীতিলতা নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন। শুধু এটুকু জানবার জন্য কে এই রামকৃষ্ণ? এমন মানুষ তো হাজার হাজার জন্মায় না। তাকে (রামকৃষ্ণ) একটি বার দেখে যে মৃত্যুর সাহস বুকে নিয়ে চট্টগ্রামে ফিরতে চেয়েছিল আমাদের প্রীতিলতা!
এদিকে সূর্য সেনের কঠোর নির্দেশ ছিল একজন বিপ্লবী অপর বিপ্লবীর সাথে প্রয়োজন ছাড়া দেখা করতে পারবেন না। কিন্তু প্রীতিলতা সেই নির্দেশ অমান্য করে বোনের পরিচয় দিয়ে দেখা করতেন রামকৃষ্ণের সাথে।সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, তাঁর (গাম্ভীর্যপূর্ণ চাউনি, খোলামেলা কথাবার্তা, নিঃশংক চিত্তে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা, ঈশ্বরের প্রতি অচলাভক্তি, শিশুসুলভ সারল্য এবং প্রগাঢ় উপলব্ধিবোধ আমার উপর গভীর রেখাপাত করলো। আগের চেয়ে আমি দশগুণ বেশি তৎপর হয়ে উঠলাম। আত্মাহুতি দিতে প্রস্তুত এই স্বদেশপ্রেমী যুবকের সঙ্গে যোগাযোগ আমার জীবনের পরিপূর্ণতাকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছিলো।’
রামকৃষ্ণ বিশ্বাস ; ছবিসূত্রঃ উইকিমিডিয়া
প্রীতিলতার জীবনী থেকে জানা যায়, এই জেলে থাকা অবস্থায় ফাঁসির আসামি রামকৃষ্ণের সাথে প্রীতিলতা প্রায় ৪০ বার দেখা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু একজন মৃত্যুর জন্য অপেক্ষমান ব্যক্তির সাথে ৪০টি বার দেখা করতে তিনি কেন গিয়েছিলেন? কেনইবা অসাধারণ মেধাবী ছাত্রী হয়েও রামকৃষ্ণের ফাঁসির পর তিনি তার লেখাপড়া ছেড়ে দেন এবং অনার্স পরীক্ষা থেকে বিরত থাকেন? এমনকি ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের পর তিনি যখন বিষপানে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন তখনো তার পকেটে পাওয়া যায় রামকৃষ্ণের ছবি। একি শুধুই এক বিপ্লবীর প্রতি অপর বিপ্লবীর সম্মান, আদর্শের প্রতীক? নাকি এসব প্রীতিলতার মানবিক সত্ত্বার বহিঃপ্রকাশ?
হ্যাঁ, একে শুধু প্রীতিলতা রামকৃষ্ণের বিপ্লবী চেতনা বলা যায় না। প্রীতিলতা-রামকৃষ্ণের প্রণয় গাঁথার এক টুকরো প্রতিফলন হলো এসব।
আর ১০টি চমৎকার ভালোবাসার কাহিনীর মতো ছিলো না এই প্রীতি-কৃষ্ণের প্রেম। এই প্রেমে ছিল না কোনো স্বীকারোক্তি, ছিল দুটি চোখের চেয়ে থাকা আর নীরবে কথা বলা। ছিল দুজনের চোখে দুজনের জন্য অশ্রু। ছিল এই ক্ষণিকের জীবন ছেড়ে অনন্তকালে মিলিত হবার প্রতিশ্রুতি। ছিল একজনের না অর্জিত স্বপ্ন আরেকজনের পূরণ করে যাওয়া, ছিল একজনের চেতনাকে বুকে ধরে অপরজনের জীবন ত্যাগ।
এই প্রেম আর অন্য প্রেমিকযুগলদের মতো নয়। ভালোবাসার গল্পের এই ঝুড়িতে রয়েছে কারাগারের চার দেয়ালের নাম যেখানে প্রীতি- কৃষ্ণ একে অপরকে প্রথম দেখেছিল। রয়েছে সেই লোহার শিকের কথা যেখানে হাত রেখে দুজন দুজনকে স্পর্শ করেছিল। আর রয়েছে সেই লোহার শিকের কথা যার দুপাশে দাঁড়িয়ে দুজন দুজনকে শেষবারের মতো দেখেছিল আর অঝোরে ভিজিয়ে ছিল দুজনের দুটি কপোল।আলিপুর জেল, ছবি : আনন্দবাজার
রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর তার (রামকৃষ্ণ) রেখে যাওয়া সেই নির্ভিক প্রেমিক মন যেন প্রীতিলতার ভেতরেই সঞ্চারিত হয়েছে। সেই অদম্য সাহস, সেই অকুতোভয় সত্তাটি যেন রামকৃষ্ণ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার প্রেয়সী প্রীতিলতাকেই দিয়ে গেছেন। আর তাই প্রচণ্ড মেধাবী হওয়া স্বত্বেও প্রীতিলতা তার লেখাপড়ার প্রতি সব আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
তিনি পারতেন নিজের জীবনকে সফলতার কেন্দ্রে নিয়ে যেতে। পারতেন রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ফাঁসির পর নতুন করে জীবন সাজাতে। কিন্তু তিনি সেই পথে হাঁটেননি। তিনি হেঁটেছেন অন্যপথে। যে পথে ব্যক্তিগত সফলতা নেই, রয়েছে নিজ জন্মভূমির সফলতা, স্বাধীনতা।
মৃত্যুকে তিনি জীবনের ইতি বা ত্যাগ নয় বরং রামকৃষ্ণের রেখে যাওয়া অপূর্ণ স্বপ্নকেই পূর্ণতা দানের হাতিয়ার মনে করে গেছেন। রামকৃষ্ণের ফাঁসির পর প্রীতিলতার মৃত্যুই যেন এই বিপ্লবীযুগলকে আবার এক করে দিয়েছে।
ছবি : বইবাজারডটকম
প্রীতিলতা যেমন বিপ্লবী সত্তা তেমন মানবিক সত্তাও। প্রীতিলতার সাথে রামকৃষ্ণের সম্পর্ক কখনো প্রীতিলতার বীরত্বকে ভোঁতা করে দিতে পারেনা। বলা হয়ে থাকে, প্রেম এবং মৃত্যু বিপ্লবীদের সহজাত একটি দিক। পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবে আক্রমণের পর তিনি যখন বিষপানে আত্মাহুতি দেন তখন তার সামরিক পোশাকের পকেটে পাওয়া যায় রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের একটি ছবি। যাকে শুধু সমবেদনা কিংবা আদর্শের প্রতীক বললে পরিপূর্ণতা পায় না। প্রীতিলতা রামকৃষ্ণের মাঝে যে প্রণয়ের সম্পর্ক ছিলো তার এক অপূর্ব পট তুলে ধরেছেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’ নামক উপন্যাসে। প্রদীপ ঘোষের পরিচালনায় একই নামের একটি চলচ্চিত্রও সম্প্রতি নির্মিত হয়েছে।
মন্তব্য করুন