সোমবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১৬ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা : বাস্তবতা নাকি মিথ?

ইসরাত জাহান তানজু
৯ জানুয়ারি ২০২১ ১৫:৩৯ |আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০২১ ০৬:২১
ছবি : কৃষি ও আমিষ ডট কম
ছবি : কৃষি ও আমিষ ডট কম

খাদ্য- বিষয়টি মানবজীবনের শুরু থেকেই ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। খাদ্য আমাদের মৌলিক চাহিদার অন্যতম যা জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু সুস্থভাবে বেঁচে থাকা ও কর্মক্ষম থাকার জন্য প্রয়োজন পুষ্টিকর খাদ্য। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ (ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হলো- ‘সব নাগরিকের অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করা।’ আবার সংবিধানের ১৮ (১) অনুচ্ছেদে অনুযায়ী ‘জনগণের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির স্তরের উন্নয়ন ঘটানোকে রাষ্ট্র তার অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য হিসেবে গণ্য করবে।’

সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য নিরাপদ খাদ্য গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। নিরাপদ খাদ্য মানুষকে সুস্থ ও সবল রাখে এবং আয়ুষ্কাল বাড়ায়। এ রকম খাদ্য মানুষকে বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধি থেকে রক্ষা করে। খাদ্য নিরাপদ হলে দেশে-বিদেশে নিশ্চিতভাবে তার ব্যবসা করা যায়। নিরাপদ খাদ্য ব্যক্তি ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়, ফলে তাদের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, যা অধিক উৎপাদনে সহায়ক।

স্বাধীনতার পরে যুদ্ধবিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছেন। খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তায় গতিশীলতা আনতে তিনি স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করছিলেন। তিনিই প্রথম গ্রহণ করেছিলেন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা উদ্যোগ। তাই খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দেওয়া খুবই জরুরি।

খাদ্য নিরাপত্তাকে সব সময়ই মনে করা হতো অধরা হরিণের মতো যা অর্জন করা কখনো সম্ভব নয়। কিন্তু স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে প্রধান প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে তিন থেকে পাঁচ গুণ। বিগত ১০ বছরে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। ১২টি প্রধান কৃষিপণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তায় আমরা অনেক দূর এগিয়ে এসেছি। ক্ষুধা নির্মূল করে আমাদের লক্ষ্য অর্জনের প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছি। কিন্তু অভ্যন্তরীণ চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে দেশীয় উৎপাদন না বাড়ায় প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ খাদ্য শস্য আমদানি করতে হয়।

উপরন্তু করোনা মহামারিতে দেশে একটা অদ্ভুত অবস্থা তৈরি হয়েছে। করোনার শুরুতে কৃষকেরা যা উৎপাদন করছেন তা বিক্রি করতে পারছিলেন না। আর বড় শহরগুলোর মানুষ খাদ্য পাচ্ছিলেন না। পরিবহন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খাদ্য সরবরাহ ভীষণভাবে ব্যাহত হয়। ফলে প্রান্তিক জনগণের আয় কমে যায়। আয় কমে গেলে মানুষ প্রথমেই খাদ্যের পেছনে ব্যয় কমিয়ে দেন। কারণ বাসা ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ তাকে দিতেই হবে। কিন্তু আশার কথা হলো করোনা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাঝেও এ অর্থবছরে খাদ্যশস্যের (চাল, গম ও ভুট্টা) উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৪ কোটি ৫৩ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। এই দুর্যোগেও বিশ্বে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

প্রতি বছর আমদানি করতে হয় বিপুল পরিমাণ চাল ও গম, ছবি : সংগৃহীত

২০১৯ সালের ১ জুলাই সরকারের খাদ্য মজুদ ছিল ১৬ দশমিক ৭৪ লাখ টন। এক বছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৮ লাখ টনে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ফুড প্ল্যানিং অ্যান্ড মনিটরিং ইউনিটের তথ্যে জানা গেছে, গত এক বছরে খাদ্য মজুদ অর্ধেক কমে গেছে। দেশে রেকর্ড পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরও সরকারি গুদামে মজুদ কমে গেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে ব্যবহারের ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে ধান ও গম উৎপন্ন হয়েছিল ৩ দশমিক ৭৬ কোটি টন, যা এর আগের অর্থ বছরের তুলনায় শূন্য দশমিক ৪৫ শতাংশ বেশি।

অর্থবছর ২০১৯ এ প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ০ দশমিক ০৪ শতাংশ। খাদ্য মন্ত্রণালয় গত ২৬ এপ্রিল থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বোরো ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল ৮ লাখ টন। কিন্তু কিনতে পেরেছিল মাত্র ২ দশমিক ২ লাখ টন, তা লক্ষ্যমাত্রার ৭২ দশমিক ৫ শতাংশ কম। সরকার ১০ লাখ টন সিদ্ধ চাল কেনার লক্ষ্য নিলেও কিনতে পেরেছিল ৬ দশমিক ৮ লাখ টন। একইভাবে দেড় লাখ টন আতপ চাল কেনার লক্ষ্য নিয়ে কিনতে পেরেছিল ৯৯ হাজার টন। মূলত করোনা মহামারি ও কয়েকদফা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের খাদ্য সহায়তা দেওয়ায় খাদ্যশস্যের মজুদ কমে গিয়েছে।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, মূলত চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় খাদ্যমূল্য বেড়েছে ৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ। গত সেপ্টেম্বরে খাদ্যমূল্যস্ফীতি ছিল সাড়ে ৬ শতাংশ এবং ২০১৯ সালের অক্টোবরে ছিল ৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ। গত অক্টোবরে বাংলাদেশে মোটা চালের গড়পড়তা খুচরা মূল্য ছিল ৪৫ টাকা কেজি, তা ২০১৯ সালের তুলনায় ৩২ শতাংশ বেশি। পাশাপাশি অন্য চালের দামও বেড়েছে। তাই ঘাটতি পূরণে করতে ভারত থেকে আড়াই লাখ টন সিদ্ধ চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।

এর আগে কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, সরকারকে ৫ থেকে ৬ লাখ টন চাল আমদানি করতে হতে পারে। আমন ধান কাটার পর এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট খাদ্যশস্য আমদানি হয়েছে প্রায় ৬৪ লাখ টন, যার মধ্যে চাল আমদানি হয়েছে মাত্র ৪ হাজার টন। মূলত করোনা সংকট মোকাবেলায় সরকারকে খাদ্য-ভিত্তিক সহায়তা কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার জন্যে খাদ্য মজুদ বাড়াতে হবে। দরিদ্রদের সহায়তার জন্যে খোলাবাজারে ভতুর্কিমূল্যে চাল বিক্রির কথা ভাবতে হচ্ছে।

একনজরে বাংলাদেশর খাদ্য আমদানির চিত্র

অন্যদিকে খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের জন্য মানুষের খাদ্য তালিকায় দিন দিন বাড়ছে গমজাত খাবারের চাহিদা। গত পাঁচ বছরে গমের উৎপাদন ২০% বাড়লেও, আমদানি করতে হয় চাহিদার ৩৫%। এছাড়াও বাংলাদেশে বাৎসরিক পেঁয়াজের চাহিদার ৪০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। যদিও বাংলাদেশে বছরে অন্যান্য যেসব খাদ্যশস্য ও মসলার যে চাহিদা তার প্রায় সবই দেশে উৎপাদন হয়। কিন্তু এর বাইরে একটি বড় অংশ খাদ্যশস্য ও অন্যান্য পণ্য আমদানি করতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে চাল, গম, ভুট্টা, পেঁয়াজ, মসুর ডাল, ছোলা, সয়াবিন তেল, চিনিসহ নানারকম নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য।

প্রতি বছর সরকারকে খাদ্য ও কৃষিপণ্য আমদানি বাবদ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, তুলা বাদে অন্যসব খাদ্য ও কৃষিপণ্য আমদানিতে প্রতি বছর ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। এর সঙ্গে তুলা আমদানিতে ব্যয়কৃত অর্থ যোগ করলে খাদ্য ও কৃষিপণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের বার্ষিক ব্যয় দাঁড়ায় ৮০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। প্রতি বছর শুধু খাদ্যশস্য আমদানিতেই বিপুল অংকের অর্থ ব্যয় করতে হয় বাংলাদেশকে। ভোজ্যতেল, তেলবীজ, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য, ডালবীজ, ফল ও মসলাপণ্যের ক্ষেত্রেও এখনো ব্যাপক মাত্রায় আমদানি নির্ভর রয়ে গিয়েছে বাংলাদেশের। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন- সঠিক পরিকল্পনাভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে এসব পণ্যের আমদানি নির্ভরতা অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে।



মন্তব্য করুন