বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪ | ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অর্জন

ইসরাত জাহান তানজু
৯ ডিসেম্বর ২০২০ ০৪:২৫ |আপডেট : ২৭ এপ্রিল ২০২১ ০১:৪৩
প্রশাসনিক কাঠামোতে নারীদের সক্রিয় পদচারণা : সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন (জেলা প্রশাসক, নরসিংদী), শামসুন্নাহার (এসপি, গাজীপুর), ওয়াহিদা আক্তার (প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-২)। ছবি : বা থেকে
প্রশাসনিক কাঠামোতে নারীদের সক্রিয় পদচারণা : সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন (জেলা প্রশাসক, নরসিংদী), শামসুন্নাহার (এসপি, গাজীপুর), ওয়াহিদা আক্তার (প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-২)। ছবি : বা থেকে

ক্ষমতায়ন হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ব্যক্তি নিজের জীবন, সমাজ, সম্প্রদায় বা সংগঠনে তার সিদ্ধান্ত জানানো বা মতামত চর্চা করতে পারে। জীবনযাত্রার বিভিন্নক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতাগুলো অতিক্রম করে সুযোগ-সুবিধা লাভ করতে পারে। এই প্রক্রিয়া ব্যক্তির আত্মসম্মানবোধ ও আত্মনির্ভরতা বাড়ায়। আর নারীদের এই জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়া হোসেন।

নারী শিক্ষার প্রসার ছাড়া নারী সমাজের মুক্তি নাই এবং সমাজের কোনো আশা নাই এই মূলমন্ত্রে বিশ্বাসী বেগম রোকেয়া সমাজের প্রবল প্রতাপের বাধা থেকে বেড়িয়ে নারী শিক্ষার জাগরণে কাজ করেছেন। সেই সঙ্গে তার আন্দোলনে যোগ হয় নারী সমাজের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। সেই পথ ধরেই বাংলাদেশ সরকার নারীদেরকে সমাজে ক্ষমতাবান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।

নারীর ক্ষমতায়ন হলো- পুরুষের সমপর্যায়ে নারীরও আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা, শিক্ষায় অংশগ্রহণ সুবিধা, নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিকার, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ইত্যাদি। এটি মূলত এক কথায় নারীর স্বকীয়তা ও স্বয়ংসম্পূর্ণতার বিকাশকে বোঝায়। সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈষম্য কমিয়ে এনে নারীকে তার অন্তর্নিহিত শক্তি ও ক্ষমতা বিকাশের সুযোগ করে দেওয়াই নারীর ক্ষমতায়ন।

১৯৯৫ সালে বেইজিং ডিক্লারেশন অ্যান্ড প্ল্যাটফর্ম ফর অ্যাকশন নারী ক্ষমতায়ন ও জেন্ডার-ইক্যুয়ালিটি আনয়নে একটি রূপরেখা তৈরি করে। এটি নারীর প্রতি বিশ্ব নেতৃবৃন্দের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয় ও নারী ক্ষমতায়নের অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। তখন থেকেই প্রায় সব দেশ নারীর সুরক্ষায় আইনি কাঠামো তৈরিকরণ শুরু করে। জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য হলো নারীর ক্ষমতায়ন।

নারীর ক্ষমতায়ন -বাংলাদেশে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত

বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়টির সুস্পষ্ট সাংবিধানিক স্বীকৃত আছে। সংবিধানে নারীর অধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা সংক্রান্ত বিভিন্ন অনুচ্ছেদ রয়েছে। সংবিধানের ১৯নং অনুচ্ছেদে রয়েছে- ‘রাষ্ট্র নাগরিকদের জন্য সকলক্ষেত্রে সমান সুযোগ নিশ্চিত করে বৈষম্য দূর করবে এবং জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে নারীদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র নিশ্চত করবে।’

২৭ নং অনুচ্ছেদে আছে- ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের উপযোগী।’ ২৮ নং অনুচ্ছেদের ১, ২, ৩, ৪নং দফায়ও দেওয়া হয়েছে সকলক্ষেত্রে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গভেদে বৈষম্যহীনতার নিশ্চয়তা। ৬৫ নং অনুচ্ছেদেও নারীকে দেওয়া হয়েছে সংসদে ও স্থানীয় শাসন প্রতিষ্ঠানসমুহে অগ্রাধিকারমূলক প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ।

আমাদের  মুক্তিযুদ্ধে নারী যোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা আজও শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। তারপরও বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের কারণে নারীরা নানান ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন। তবে বর্তমানে এই বাস্তবতা থেকে আমরা অনেকখানি দূরে চলে এসেছি। তাই নারী অগ্রগতির এই আলোকোজ্জ্বল প্রভাতে দিকে দিকে তাদের সাফল্যের জয়ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

নারী ক্ষমতায়নে সরকারের সাফল্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত

হার্ভার্ড ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) যৌথ উদ্যোগে করা জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট অনুসারে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অবস্থান বিবেচনায় নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের নাম আছে এক নম্বরে। তবে নারীর সার্বিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৮তম। নারী উন্নয়নের সার্বিক সূচকে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ২৪টি দেশের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার পরে দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। সাড়া বিশ্বের ৩৬টি নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ২য়।

দ্য গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট অনুসারে, বিশ্বের ১৪৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৭ তম, যা এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় আশাব্যঞ্জক। নারী শিক্ষার উন্নয়ন এবং ব্যবসায়িক উদ্যোগে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য গ্লোবাল উইমেনস লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়া জাতিসংঘের ‘প্ল্যানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ ও ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ’ অ্যাওয়ার্ডেও ভূষিত হয়েছেন তিনি।

বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের সার্বিক চিত্র

রাজনীতি

নারীর ক্ষমতায়নের জন্য সরকার বেশ কিছু আইন-নীতি ও বিধিমালা তৈরি করেছে। ২০১১ সালে প্রগতিশীল নারী উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ৫০ এ উন্নীত করা হয়েছে। বাংলাদেশই সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে সংসদ নেতা, সংসদীয় উপনেতা, বিরোধী দলীয় নেত্রী ও স্পিকার, শিক্ষা মন্ত্রী নারী। বর্তমানে ৭২ জন নারী সাংসদ রয়েছেন।

স্থানীয় পর্যায়ে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত নারী প্রতিনিধি আছে ১২০০০ এর মতো। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় ৩৩ শতাংশ আসন নারীদের জন্য রাখা হয়েছে। আর জনসেবা খাতে নারীর প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে বিশেষ বিধান রাখা হয়েছে। ২০২০ সাল নাগাদ সকল রাজনৈতিক দলের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী সদস্য রাখার বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।


রাজনৈতিক নেতৃত্বের শীর্ষ অবস্থানে পদচারণাকরী নারীমুখগুলো, ছবি : সংগৃহীত

প্রতিটি উপজেলা পরিষদে ১ জন নির্বাচিত মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের পদ রাখা হয়েছে।সরকারের উদ্যোগে ২০১০ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে ব্যাংকিং ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান ৫৭ হাজার নারী উদ্যোক্তাকে ৮৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তা দিয়েছে। ২০১৬ সালে ১১ হাজার নারী ১.২ মিলিয়ন ডলারের বেশি ক্ষুদ্র ঋণ পেয়েছে।সরকার বরাবরই সরকারি-বেসরকারিভাবে নারীর ক্ষমতায়ন ও আত্মনির্ভরশীলতাকে উৎসাহিত করে আসছে। যার স্বীকৃতিস্বরূপ আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদার তেরেসা পুরস্কার,ইউনেস্কো শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

শিক্ষা

শিক্ষাখাতে বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন চোখে পড়ার মতো। বর্তমানে দেশে নারী শিক্ষার হার ৫০.৫৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) হিসেব অনুযায়ী, বর্তমানে প্রাথমিক পর্যায়ে মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৫১ শতাংশ, মাধ্যমিক পর্যায়ে ৫৪ শতাংশ, এইচএসসি পর্যায়ে ৪৮.৩৮ শতাংশ নারী।

বিগত সময়ের তুলনায় বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি), জেএসসি-জেডিসি এবং এসএসসি পরীক্ষায় সাফল্য ও জিপিএ-৫ অর্জনের দিক থেকেও নারীরা এগিয়ে আছে। সরকার শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করে প্রাথমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত নারীদের শিক্ষা বৃত্তি প্রদান করছে।

প্রাথমিক শিক্ষায় নারী শিশুদের ভর্তির হার বিবেচনায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান আরও ৬২টি দেশের সঙ্গে সমন্বিতভাবে প্রথম। মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। তবে উচ্চশিক্ষায় এখনও অনেক পিছিয়ে আছে এদেশের নারীরা। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আছে ১১৯ নম্বরে।


প্রত্যন্ত এলাকায়ও বেড়েছে নারীশিক্ষা বিষয়ে সচেতনতা, ছবি : সংগৃহীত

শুধু শিক্ষাই নয়,রাজনীতি, অর্থনীতি, খেলাধুলা থেকে শুরু করে চিকিৎসাবিদ্যা,দেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নেতৃত্ব প্রদান,সংস্কৃতির চর্চা,আইটি সেক্টর,সফল উদ্যোক্তা হওয়া, প্রতিরক্ষাক্ষেত্রসহ সকলক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারীরা তাদের ক্ষমতা ও দক্ষতার প্রমাণ দিচ্ছে।

ঘরে বাইরে, দেশে ও বিদেশে নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশে বিশ্বের রোল মডেল হয়ে উঠেছে। নারীরা এখন রাষ্ট্র পরিচালনা করছে,পর্বত জয় করছে,বিমান থেকে শুরু করে ট্রেন অপারেট করছে,খেলাধুলায় বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হচ্ছে। জেন্ডার-ইক্যুয়ালিটি প্রতিষ্ঠায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবার ওপরে আছে বাংলাদেশের নাম।

প্রশাসন

নারীরা এখন উচ্চ আদালতের বিচারক, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, মন্ত্রণালয়ের সচিব, বিজিএমইএর সভাপতি, জাতিয় প্রেসক্লাবের সাধারণন সম্পাদক এবং আরও অনেক কিছু হয়ে উঠছেন। জেন্ডার বাজেটিং, মাইক্রো ফাইনান্সের মত উদ্যোগগুলো নারীদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করেছে।নারীদের ক্ষেত্রে সরকারের বিনিয়োগ সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রকে সমৃদ্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে সুফল বয়ে আনছে। আজ দুই কোটি নারী কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে নিয়োজিত এবং ৩৫ লাখেরও বেশি নারী তৈরি পোষাক খাতে কাজ করছেন, যা আমাদের রপ্তানি আয়ের সবচেয়ে বড় ও সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র।বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশে নারী কর্মসংস্থান ৩ শতাংশ উন্নতি হয়ে ৩৫ থেকে ৩৮ শতাংশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এই হার ২৯ শতাংশ।

সর্বশেষ তথ্য মতে, প্রায় ১ হাজার নারী সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে দায়িত্ব পালন করেছেন। নারীরা আজ বিচারপতি, সচিব, ডেপুটি গভর্নর, রাষ্ট্রদূত, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মানবাধিকার কমিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। প্রশাসনের উচ্চপদে আছেন ৫৩৫ জন নারী কর্মকর্তা। উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত পদগুলোতে এই নারী কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমানে প্রশাসনে সিনিয়র সচিব, সচিব ও ভারপ্রাপ্ত সচিব রয়েছেন ৬ জন নারী। অতিরিক্ত সচিব রয়েছেন ৮১ জন, যুগ্ম-সচিবের মধ্যে নারী রয়েছেন ৮৭ জন। প্রশাসনে ১ হাজার ৮৪০ জন উপসচিবের মধ্যে নারী উপসচিব রয়েছেন ৩৬১ জন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ, ২০১৭ সালের পরিসংখ্যান মতে, সরকারি চাকরিতে মোট নারীর সংখ্যা ৩ লাখ ৬৮ হাজার ৮১৯ জন। মাঠ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে গত বছর পর্যন্ত নয়টি জেলায় নারী ডিসিরা দায়িত্ব পালন করছেন।

খেলাধুলা

খেলাধুলায় বাংলাদেশের নারীরা ঈর্ষণীয় সাফল্য রাখছে। ক্রিকেট, ফুটবল ও অন্যান্য খেলায় দেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের সাফল্য ধরে রেখেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নারী ক্রিকেটের গর্ব ফাতেমা জাহারার কথা।তিনি অস্ট্রেলিয়ার লিজেন্ডারি নিউ সাউথ ওয়েলস একাডেমিতে বেশ কিছুদিন কোচ হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান, যা শুধু নারী ক্রিকেটেকেই না, আমাদের পুরো ক্রিকেট ইতিহাসকেই এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। নারী ক্রিকেটের আরেক রত্ন জয়া চাকমা। দক্ষিণ এশিয়ায় বর্তমানে চারজন নারী রেফারি ফিফার দায়িত্ব পালন করছেন। দুইজন ভারতের,বাকি দুইন নেপাল ও ভুটানের। ফিফার পঞ্চম এবং এশিয়ার আরেক নারী রেফারি হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন এই জয়া চাকমা। আমাদের অনূর্ধ্ব-১৫ নারী ফুটবল দল সাফ অনূর্ধ্ব–১৫ চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হয়। এর আগে ভারতে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দল রানারআপ হয়।

বিজ্ঞান

বাংলাদেশের নারী বিজ্ঞানী ড.ফিরদৌস কাদরি, যিনি আইসিডিডিআরবির মিউকোসাল ইমিউনোলজি এন্ড ভ্যাসিনোলজি ইউনিট অব ইনফেকশাস ডিজিজ ডিভিশনের প্রধান। তিনি ল'রিয়েল ইউনেস্কো ফর উইমেন ইন সাইন্স অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। উন্নয়নশীল দেশের শিশুদের সংক্রামক রোগ নিয়ে গবেষণা করে তিনি এই সম্মাননা অর্জন করেন। এ বছরের ১২ মার্চ তাকে প্যারিসে ইউনেস্কোর প্রধান কার্যালয়ে ১ লাখ ইউরো ও সম্মাননা সনদ প্রদান করা হয়। বাংলাদেশের আরেক কৃতি শিক্ষার্থী মাহজাবিন হক নাসায় দ্বিতীয় দফা ইন্টার্নিশিপ শেষ করে সেখানেই যোগ দিতে যাচ্ছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান রাজ্যের ওয়েন স্টেট ইউনিভার্সিটির কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে স্নাতক শেষ করেন। তিনি টেক্সাসের হিউস্টনে অবস্থিত নাসার জনসন স্পেস সেন্টারে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার  হিসেবে যোগ দেবেন।

কৃষি, শিল্প ও সেবাখাত


সেবাখাতে নারীর অংশগ্রহণ দেশের জিডিপি বৃদ্ধির বড় কারণ, ছবি : সংগৃহীত

বর্তমানে ১.৬৮ কোটি নারী কৃষি, শিল্প ও সেবা—অর্থনীতির মত বৃহত্তর-তিন খাতে যুক্ত আছেন। অর্থনীতিতে তাদের আরেকটি বড় সাফল্য হলো, উৎপাদন ব্যবস্থায় ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ। মূলধারার অর্থনীতি হিসেবে স্বীকৃত উৎপাদন খাতের মোট কর্মীর প্রায় অর্ধেকই এখন নারী। এ খাতে ৫০.১৫ লাখ নারী-পুরুষ কাজ করেছেন। তাদের মধ্যে নারী ২২ লাখ ১৭ হাজার। তবে নারী কর্মীদের সিংহভাগই শ্রমজীবী। বাকিরা কেউ কেউ উদ্যোক্তা, কেউ চিকিৎসক বা প্রকৌশলী। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শীর্ষ নির্বাহী ও উচ্চপদেও দায়িত্বরত আছেন নারীরা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

অর্থনীতির ভাষায় এই নারীদের অর্থনীতির সক্রিয় কর্মী (ইকোনমিক্যালি অ্যাকটিভ) বলা হয়। তাঁরা একদিকে যেমন তাঁদের কাজের জন্য মজুরি বা বেতন পচ্ছেন, আবার এসব কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে মূল্য সংযোজন অর্থনীতিকেও সমৃদ্ধ করছেন।প্রতিবছর গড়ে দুই লাখ নারী কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে যুক্ত হচ্ছেন। কর্মসংস্থান ও শ্রমবাজার নিয়ে বিবিএসের দেওয়া প্রাথমিক তথ্যে দেখা গেছে, ২০১০ সালে দেশের ১.৬২ কোটি নারী কোনো না কোনোভাবে কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন। ২০১৩ সালে এসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১.৬৮ কোটিতে।

কর্মজীবী নারীদের অর্ধেকের বেশি কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিবিএস বলছে, বর্তমানে কৃষি খাতে নিয়োজিত আছেন ৯০ লাখ ১১ হাজার নারী। এ ছাড়া শিল্প ও সেবা খাতে কাজ করেন যথাক্রমে ৪০ লাখ ৯০ হাজার এবং ৩৭ লাখ নারী। বিবিএসের হিসাবে, বর্তমানে প্রায় ৫ কোটি ৮০ লাখ নারী-পুরুষ কোনো না কোনোভাবে কাজে সম্পৃক্ত রয়েছেন। উল্লেখ্য যে, সপ্তাহে কমপক্ষে এক ঘণ্টা কাজ করেন এমন ব্যক্তিকে বেকার হিসেবে ধরা হয় না। শিক্ষক, নির্মাণকর্মী, বিজ্ঞানী, ব্যাংকার, উদ্যোক্তা, শিল্পী, গণমাধ্যমকর্মী— প্রায় সব পেশাই বেছে নিচ্ছেন নারী।

তথ্য প্রযুক্তি

তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের নারীদের সাফল্য কিছুটা কম হলেও এই সেক্টরে নারীদের জন্য রয়েছে বিশাল সম্ভাবনা।বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া নারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশ তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ে পড়াশুনা করছে। তবে সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে তারা কর্মক্ষেত্রে আশানুরূপ সাফল্য লাভ করতে পারছে না। সরকারি হিসাব মতে, কর্মক্ষেত্র হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে বেছে নিয়েছেন মাত্র ১২ শতাংশ নারী। তারা অধিকাংশই প্রাথমিক বা মধ্যম পর্যায়ের কাজ করছেন, নীতি নির্ধারনী পর্যায়ে তাদের অবস্থান শতকরা ১ শতাংশের চেয়েও কম।বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক (বিডিওএসএন) এর এক জরিপে মতে, তথ্যপ্রযুক্তিতে পড়াশুনা করছে এমন শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাত্র ১ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী ভবিষ্যতে প্রোগ্রামিংকে পেশা হিসেবে নিতে আগ্রহী।

অথচ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও গণিত বিষয়ে চাকরির সুযোগ প্রতি বছর বাড়ছে ১৭ শতাংশ হারে।যেখানে অন্যান্য খাতে এ বৃদ্ধির পরিমাণ মাত্র ১০ শতাংশ।  শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্রবিশ্বেই প্রকৌশল ও প্রযুক্তিখাতে নারীদের অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে কম। ইউনেস্কোর একটি রিপোর্টে দেখা গেছে, জাপানের মতো প্রযুক্তিতে উন্নত একটি দেশে মাত্র ৫ শতাংশ নারী প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করছেন। কোরিয়াতে এ হার ১০ শতাংশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯ শতাংশ এবং ফিনল্যান্ডে ২২ শতাংশ। সব দেশকে ছাপিয়ে এক্ষেত্রে সবার উপরে অবস্থান করছে শ্রীলঙ্কা–সেখানে প্রায় ৫০ শতাংশ নারী প্রকৌশলী রয়েছেন।

বর্তমান সরকার তথ্য প্রযুক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে দশ হাজারেরও বেশি দক্ষ নারী জনবল গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিশ্ব ব্যাংকের আর্থিক সহযোগিতায় পরিচালিত লিভার্জিং আইসিটি ফর গ্রোথ, এপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড গভর্নেন্স (এলআইসিটি) প্রোজেক্টের অধীনে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ নারী যাতে অংশগ্রহণ করে সেই লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্দীপনামূলক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে এবং বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) উদ্যোগে পরিচালিত এই এলআইসিটি প্রোজেক্টে এ পর্যন্ত প্রায় ৩৪ হাজার নারী ও পুরুষকে আইসিটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে প্রশিক্ষিত ১০ হাজার নারীকে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে।

প্রযুক্তি খাতে পেশাগতভাবে জড়িত নারীদের একটি প্রধান সংগঠন বাংলাদেশ উইমেন অ্যান্ড টেকনোলজি (বিডব্লিউআইটি)। সংগঠনটি জন্মলগ্ন থেকেই কাজ করছে তথ্যপ্রযুক্তিতে ক্যারিয়ার গড়তে আগ্রহী নারীদের জন্য। দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত ও কর্মক্ষেত্রে উপযুক্ত কাজের পরিবেশ তৈরির জন্য কাজ করছে সংগঠনটি।

শেষ কথা

স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরে আজকের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন আসলেই তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। কিন্তু সমাজের সব স্তরে, সব জায়গায়, সব সম্প্রদায়ে এই ক্ষমতায়ন সমান হারে হয়নি। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, জেন্ডার, পেশা, অঞ্চলসহ সামাজিক নানা স্তর বিন্যাসভেদে এই ক্ষমতায়নের মাত্রা ও ধরন বিভিন্ন। নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে নারীর উপস্থিতি এখনো হাতে গোণা। তাই নারী উন্নয়নে আমাদের যেতে হবে অনেক দূর।

আমাদের সমাজে নারীর প্রতি পরিপূর্ণভাবে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠেনি। গ্রামে নারীরা গৃহস্থালি, কৃষি ও পশু পালনের মতো উৎপাদনশীল কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকলেও তার স্বীকৃতি নেই। শহরেও নারীর গৃহস্থালি কাজের কোনো স্বীকৃতি নেই। নারী উন্নয়নে এখনো রয়েছে অনেক অনেক বাধা। নারীর প্রতি সরকার, সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ ও সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। ইতিবাচক কর্মকাণ্ডে নারীকে উৎসাহিত করার জন্য নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। আইনগত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।



মন্তব্য করুন