শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ৭ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কোরিয়া বিভক্তির নেপথ্য

রিজুয়ানা রিন্তী
২৩ ডিসেম্বর ২০২০ ০৫:২৬ |আপডেট : ৮ জুলাই ২০২৪ ০৯:১৫
স্নায়ুযুদ্ধে কোরিয়ান উপদ্বীপ ভেঙে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। প্রতীকী ছবি
স্নায়ুযুদ্ধে কোরিয়ান উপদ্বীপ ভেঙে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। প্রতীকী ছবি

একসময় কোরিয়া ছিল অবিভক্ত এবং শান্তিপূর্ণ একটি দেশ। আরও ৭০ বছর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধের কারণে কোরিয়ান উপদ্বীপ ভেঙে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

সময়ের হিসেবে বললে তখন ১৯১০ সাল। সেসময় কোরিয়ার অধীপতি ছিলেন জসন সাম্রাজ্যের রাজা গুজুং। জসন সাম্রাজ্য প্রায় ৬০০ বছর ধরে শান্তিপূর্ণভাবে কোরিয়া শাসন করছিল। কিন্তু সেই শান্তি এরপরে আর বেশি দিন স্থায়ী হলো না। যুদ্ধবাজ জাপানিরা কোরিয়া আক্রমণ করে বসল। জোর করে দখল নিলো কোরিয়া উপদ্বীপের মসনদ। শুরু হলো কোরিয়ার বুকে জাপানি শাসন, সমান্তরালে চলল শোষণও। জাপানিদের কোপ শুরুতেই পড়ল কোরিয়ান সংস্কৃতির ওপর। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল- প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম থেকে দেশীয় ইতিহাস এবং সংস্কৃতি সম্পর্কিত সবধরনের শিক্ষা নিষিদ্ধ ঘোষণা, কোরিয়ানদের দেশীয় উৎসব পালনে কড়াকড়ি জারি, কোরিয়ান ভাষা ব্যবহার নিষিদ্ধ করা।


জাপান কর্তৃক কোরিযা দখলের ২৯ বছর পর ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো। এ যুদ্ধে প্রধান দুইটি পক্ষ ছিল- অক্ষশক্তি ও মিত্রশক্তি। অক্ষশক্তির মধ্যে জার্মান ও ইতালি ছিল মূল দেশ। আর তাদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা মিত্র শক্তির প্রধান দেশ ছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমানে রাশিয়া) ও চীন। স্বভবতই জাপান যোগ দিয়েছিল আক্রমণকারী অক্ষশক্তির দলে। তারা ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে অক্ষশক্তিতে যোগদান করে এবং প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল হারবার আক্রমণ ও ইউরোপীয় উপনিবেশগুলো আক্রমণ করে জয়লাভ করতে সক্ষম হয়।

কথায় আছে ‘সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়। জাপান বিষয়টি হাঁড়ে হাঁড়ে টের পেয়েছিল মার্কিনীদের হিরোশিমা নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলার পরই। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট হিরোশিমায় ও ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায় নগরী দুটি। জাপান আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ফলে কোরিয়ান উপদ্বীপের মালিকানা হাতছাড়া হয় জাপানের।


কোরিয়ানরা ভেবেছিল এখন থেকে তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। কিন্তু ভাগ্য তাদের সহায় ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জয়ী সেসময়ের দুই পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র কোরিয়া দখল নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। কোরিয়ার মাটিতে মার্কিনদের কোনো ঘাঁটি না থাকার সুবিধা নিয়ে সোভিয়েত আগেভাগেইে উত্তর দিক থেকে কোরিয়ায় হামলা চালিয়ে জাপানি সেনাদের হটিয়ে কোরিয়া দখল নিতে থাকে। খবর পেয়ে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ থেকে হামলা করতে করতে সামনে এগুতে থাকে। ৩৮ ডিগ্রি অক্ষরেখাতে মুখোমুখি হলো দুই পরাশক্তি। ফলে মালিকানার স্বীকৃতি নিয়ে মনস্তাত্ত্বিক লড়াই চলতে থাকল তাদের মধ্যে।

কার অধীকৃত সীমানা কতটুকু তা নির্ধারণে মার্কিন সেনা কর্মকর্তা কর্নেল চার্লস বনস্টিল এবং ডিন রাস্ককে ৩০ মিনিট সময় দেওয়া হলো। তারা ৩৮ ডিগ্রি সীমারেখা বরাবর কোরিয়াকে দুভাগ করে ফেলার প্রস্তাবনা পেশ করেন। দুই দেশই এ প্রস্তাবে সায় দেওয়ায় এটিই চূড়ান্ত করা হলো। তবে সেসময় বলা হয়েছিল এ বিভাজন সাময়িক। দ্রুতই কোরিয়াকে স্বাধীন করে একীভূত করা হবে। তবে নতুন রাষ্ট্রের সরকার ব্যবস্থা কোন ধরনের হবে তা নিয়ে আবার যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েতের মতানৈক্য দেখা দিলো। যুক্তরাষ্ট্র ছিল গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, আর সোভিয়েত সমাজতন্ত্রে। দুই দেশই তাদের নীতি নতুন রাষ্ট্রে প্রয়োগ করতে চাইলো।

পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ার নিজেদের অনুগত গণতান্ত্রিক নেতা সিঙ্গমান রি কে দক্ষিণ কোরিয়ার শাসক হিসেবে নির্বাচিত করে। ১৯৪৮ সালে রির তত্ত্বাবধানে দক্ষিণ কোরিয়া স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের বুকে আত্মপ্রকাশ করে। অপরদিকে সোভিয়েত উত্তর কোরিয়ার সামরিক কর্মকর্তা স্বৈরাচারী কিম ইল সুংকে সেদেশের শাসনভার দেয়।


দুই কোরিয়ায় দুই ধরনের শাসন ব্যবস্থা থাকায় তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত লেগেই থাকতো। এর উপর ছিল দুই পরাশক্তির ইন্ধন। ফলে কোরিয়া একীভূত হওয়া তো অনেক পরের বিষয়, তারা নিজেরাই জড়িয়ে পড়ল যুদ্ধে। ১৯৫০ সালে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম ইল সুং দক্ষিণে আক্রমণ করে বসলেন। দক্ষিণ কোরিয়া পাল্টা আক্রমণ শুরু করলে কোরিয়ার ইতিহাসে অন্যতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ‘কোরিয়া যুদ্ধর সূচনা হয়। যুদ্ধে পরোক্ষভাবে জড়িয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়াকে সমর্থন দিলেও রাশিয়া ও চীন উত্তর কোরিয়াকে সমর্থন দেয়। যুদ্ধ চলাকালীন তারা উত্তর কোরিয়ায় বিভিন্ন অস্ত্র রসদ দিয়ে সাহায্য করে। প্রায় তিন বছর স্থায়ী হয় কোরিয়া যুদ্ধ। যুদ্ধে প্রায় ৩০ লাখ কোরিয়ান নিহত হয়। ১৯৫৩ সালে দুইপক্ষের মাঝে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে এ যুদ্ধ শেষ হয়।


চুক্তি অনুযায়ী, ৩৮ ডিগ্রি সীমারেখায় দুদেশের মাঝে তিন মাইল ব্যাপী ‘নো ম্যানস ল্যান্ড নির্ধারণ করা হয়। এ অঞ্চলে রক্তপাত নিষিদ্ধ। এটি এখন পরিচিত পানমুনজাম গ্রাম নামে। বিখ্যাত পিস হাউস এখানেই অবস্থিত।

৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে উত্তর কোরিয়া শাসন করেন কিম ইল-সুং। এরপর তার জায়গায় দেশটির শাসন ক্ষমতায় বসেন কিম জং-ইল। আর বর্তমানে দেশটির সুপ্রিম লিডার হিসেবে রয়েছেন কিম জং ইল পুত্র কিম জং-উন। এদিকে ২০১৭ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মুন জে-ইন।

দুই কোরিয়ার মাঝে পরমাণু হামলার হুমকি নিয়ে বৈরিতা বিরজ করলেও সর্বশেষ ২০১৮ সালের ১৭ এপ্রিল দুই কোরিয়ার শীর্ষ নেতা একসাথে বৈঠকে বসেন। বৈঠকের আগে কিম উত্তর কোরিয়ার মাটিতে পা রাখেন। কোরিয়ার যুদ্ধের পর এই প্রথম উত্তর কোরিয়ার কোনো নেতা দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্তে প্রবেশ করেন। এরপর তারা বৈঠকে কোরীয় উপদ্বীপকে সম্পূর্ণভাবে পরমাণু অস্ত্রমুক্ত করার লক্ষ্যে একযোগে কাজ করতে সম্মত হয়েছিলেন। এসময় তারা কোরীয় উপদ্বীপে আর কোনও যুদ্ধ না করার অঙ্গীকারও করেন।

তবে এ ঘোষণা যে শুধুই লোক দেখানো ছিল তার প্রমাণ ইতোমধ্যেই দিয়েছেন উত্তরের অধিপতি কিম জং উন। চলতি বছরের (২০২০) ৯ জুন দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সব ধরনের আন্তঃকোরিয়ান যোগাযোগ বন্ধ রাখার কথা জানিয়েছে উত্তর কোরিয়া। এমনকি দুই দেশের নেতাদের যোগাযোগের হটলাইনও বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছেন তারা। দক্ষিণ কোরিয়াকে ‘শত্রু উল্লেখ করে উত্তর কোরিয়া জানায়, এটি আগামীতে দেশটির বিরুদ্ধে নিতে নেওয়া কয়েকটি পদক্ষেপের একটি মাত্র।

কোরিয়া বিবক্তির কারণ হিসেবে মূলত দুইটি বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া হয়। আপাতত দৃষ্টিতে মনে হয় যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নেরর মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধের কারণেই কোরিয়া বিভক্ত হয়। তবে জাপান যদি কোরিয়া আক্রমন করে তা দখল না করত, তাহলে হয়ত কোরিয়ানরা বিভক্ত হতো না। বিভক্তির দগদগে ঘা দীর্ঘ ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে তাদের। 

কোরিয়া বিভক্তি বড়ই করুণ ও বেদনার। দেশভাগের ফলে লাখ লাখ মানুষ তার পরিবাররকে হারিয়েছে। বিগত ৭০ বছরে বহু কোরীয়ান নাগরিক এই কষ্ট বুকে নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। ‘আশায় বাঁচে চাষা এ প্রবাদটির চাষাদের মতো দুই কোরিয়ার জনগণ এখনো আশা করে, বিশ্বাস করে, স্বপ্ন দেখে কোনো একদিন ভোরে উঠে হয়ত তারা দেখবে দুই কোরিয়া আবার এক হয়ে গেছে। সবই ফিরে পেয়েছেন তাদের স্বজনদের। তবে কোরীয় জনগণের দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এ স্বপ্ন বাস্তব করার চাবিকাঠি তাদের হাতে নেই। দুই কোরিয়া এক হবে কি হবে না, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া ও তা বাস্তবায়ন শুধু তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে না। এখানে জড়িয়ে আছে বিশ্বনেতাদের ও দেশ দুটির নিজস্ব রাজনৈতিক দলের স্বার্থ।



মন্তব্য করুন