রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪ | ৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশের অর্থনীতির হালচাল : সফলতা বনাম ব্যর্থতা

ইসরাত জাহান তানজু
১ ডিসেম্বর ২০২০ ১৪:৪৯ |আপডেট : ২০ এপ্রিল ২০২১ ১৯:০৯
পোশাক কারখানায় নারী শ্রমিকদের ব্যস্ততা, ছবি : বাংলা ট্রিবিউন
পোশাক কারখানায় নারী শ্রমিকদের ব্যস্ততা, ছবি : বাংলা ট্রিবিউন

বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি। বিকাশের দ্রুতগামীতা ও অপার সম্ভাবনার কারণে বাংলাদেশের অগ্রগতিকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। ভৌগোলিকভাবেই বাংলাদেশের অর্থনীতি উৎপাদনশীলতার দিক দিয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। অপরদিকে বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপ হওয়ায় অনুকূল আবহাওয়া, ভূমির উর্বরতা, জলবায়ুগত কারণে মানুষের কর্মশক্তি ও জীবনীশক্তি ইত্যাদি এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জনের অন্যতম প্রধান নিয়ামক। বাংলাদেশের অগ্রগতির মূলে রয়েছে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাত।

বাংলাদেশের অর্থনীতি স্বল্প মধ্যম আয়ের। কেবল উন্নয়নই নয়, রয়েছে এর বিপরীত চিত্রও। এর সার্বিক বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে রয়েছে- মধ্যম হারের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি, পরিব্যপ্ত দারিদ্র্য, আয় বণ্টনে অসমতা, বেকারত্ব, মূলধনী যন্ত্রপাতি, জ্বালানী ও খাদ্য শস্যের জন্য আমদানি নির্ভরতা, রেমিট্যান্সের ক্রমবর্ধমান পার্যাপ্ততা, সঞ্চয়ের নিম্নহার, বিদেশি সাহায্যের ওপর ক্রমহ্রাসমান নির্ভরতা, কৃষিখাতের সংকোচনের সঙ্গে সঙ্গে সেবাখাতের দ্রুত সম্প্রসারণ, সম্ভাবনাময় পোশাক খাত ইত্যাদি। রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগে কারণে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ খাদ্য-শস্য ও কাঁচামালের ফলন নষ্ট হওয়ার প্রবণতা। দুর্নীতি, ঘুষব্যবসা ও অর্থ-আত্মসাৎ বাণিজ্যও এ দেশের নিত্যচিত্র।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অর্জনসমূহ :

বাজেট

১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করেছে। তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়িসহ আরও অনেক ধরনের অন্যায় ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথাবার্তা বলেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় বাজেট ঘোষণা দেওয়া হয় ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সেই সময় ৭৮৬ কোটি টাকা সমমূল্যের বাজেট তৈরি করেন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সেই বাজেটের আকার দাঁড়ায় ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকায়, যা তৎকালীন সময়ের বাজেটের তুলনায় প্রায় ৬৬৫ দশমিক ৬৪ গুণ বড়।

জিডিপি

১৯৭২ সালে মোট দেশজ উৎপাদান (জিডিপি) ছিল ৬০৮ কোটি ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে স্থিতিশীল মূল্যহারে এই জিডিপির আকার ১১৬৩৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার। করোনা মহামারির ভয়বহতার পরও এ বছর জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২৪। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ২৫ বছর পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে চার শতাংশের ওপরে ওঠেনি। এর মধ্যে ১৯৭৩-৭৪ থেকে ১৯৭৯-৮০ সময়ে প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র গড়ে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। পরের ১০ বছর জিডিপি বেড়েছে প্রায় ৫ শতাংশ। এরপর ৬ শতাংশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই হার ছিল ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে আমাদের অর্থনীতির আকার ৪৫ গুণেরও বেশি বড় হয়েছে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকিং ও আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং কর্পোরেশনের (এইচএসবিসি) রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৩ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ হারে। এর পরের পাঁচ বছর ২০২৩ থেকে ২০২৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধি হবে ৭ শতাংশ হারে। অর্থাৎ আগামী এক যুগ বাংলাদেশে গড় প্রবৃদ্ধি হবে ৭ দশমিক ১ শতাংশ হারে। আর বাংলাদেশের এই প্রবৃদ্ধির হার বিশ্বের সব দেশের প্রবৃদ্ধির হারের তুলনায় বেশি হবে।

রেমিট্যান্স

সুখবর হলো বছরের প্রথমার্ধে রেমিটেন্স ২৫ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বৃদ্ধিটা এসেছে প্রধানত সৌদি আরব, ওমান, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য থেকে। সেখানে কর্মরত বাংলাদেশিদের আয় কিছুটা বেড়েছে এবং জীবিকা নির্বাহের খরচ সেই তুলনায় খুব একটা বাড়েনি। যার ফলে তারা আগের তুলনায় বেশি সঞ্চয় করে দেশে বেশি টাকা পাঠানোর ক্ষমতা অর্জন করেছেন। দেশের অর্থনীতির দুর্বলতার কারণে তাদের পরিবারকে সহায়তার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। সেক্ষেত্রে সরকারের দেওয়া দুই শতাংশ ভর্তুকি তাদের বেশি টাকা পাঠাতে উৎসাহিত করছে।

বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে, যা অক্টোবরের শেষ নাগাদ ৪১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। প্রয়োজনীয় আমদানি ব্যয় পরিশোধ ও বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পের খরচ নির্বাহে এটি পরম নির্ভরতা হিসেবে কাজ করবে।

মাথাপিছু আয়

মানুষের বার্ষিক মাথাপিছু গড় আয় দুই হাজার ডলার অতিক্রম করেছে। বিদায়ী অর্থবছর (২০১৯-২০) শেষে দেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৪ ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মাথাপিছু গড় আয় ছিল ১ হাজার ৯০৯ ডলার। অর্থাৎ, দেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় এক বছরের ব্যবধানে ১৫৫ ডলার বেড়েছে।

অনুদানে নিম্নগতি ও ঋণের ঊর্ধ্বগতি

অর্থনৈতিক অগ্রগতির কারণে একদিকে যেমন নিজেদের টাকায় মেগাপ্রকল্প নির্মান করার সামর্থ্য ও সম্ভাবনা বেড়েছে, অন্যদিকে বিদেশি সহায়তা বা অনুদানের পরিমাণও কমেছে বিপুল হারে। দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হওয়ায় বৈদেশিক সহায়তায় অনুদানের পরিমাণ ন্যূনতমপর্যায়ে নেমে এসেছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বৈদেশিক সহায়তায় অনুদানের পরিমাণ ছিল ৮৪ থেকে ৮৬ শতাংশ, ঋণ ছিল ৬ থেকে ৮ শতাংশ। এখন সেই অনুদানের পরিমাণ নেমে এসেছে ৩ শতাংশে। ২০০৯-১০ সালের দিকে অনুদান এসেছে ৩০ শতাংশের মতো, ৭০ শতাংশের মতো আসল ঋণ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে অনুদান এসেছে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ, আর ৯৫ শতাংশই এসেছে ঋণ হিসেবে। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে অনুদান আরও কমে গেছে। ঋণের হার ২/৩ শতাংশের মধ্যে রয়েছে, ৯৭ শতাংশেই এসেছে লোন হিসেবে। অর্থাৎ বাংলাদেশ এখন আর দানের ওপর নির্ভরশীল নয়, নিজস্ব দক্ষতার আর কর্মশক্তির ওপর নির্ভরশীল।

অর্থছাড়ের পরিমাণ কমলে ও জিডিপিতে তার হিস্যা কম

১৯৯৭-৯৮ সালে বাংলাদেশের (বৈদেশিক সহায়তার) ডিসবার্সমেন্ট (অর্থছাড়) ছিল ৭৪৮ মিলিয়ন ডলার, তখন জিডিপির ৩০ দশমিক ৪৭ শতাংশ ছিল ঋণের পরিমাণ। ২০১৯-২০ সালে ডিসবার্সমেন্ট হচ্ছে ৭ হাজার ১২১মিলিয়ন ডলার, কিন্তু এটা আমাদের জিডিপির মাত্র ১৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ। এই সময়ের মধ্যে ডমেস্টিক ইনভেস্টমেন্ট অনেক বেড়ে যাওয়ার কারণে টাকা বাড়ার পরও জিডিপির সঙ্গে এর অনুপাতটা অনেক কমে এসেছে।

দারিদ্র্যতা হ্রাস

বিবিএস-এর তথ্যমতে, বাংলাদেশে ২০০৯ সালে ৫ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করত। তাদের মধ্যে প্রায় তিন কোটি মানুষ ছিলেন চরম দরিদ্র অবস্থায়। ২০১৮ সালের তথ্যমতে, দারিদ্র্য সীমার নীচে বাস করে পৌনে চার কোটি মানুষ। আর চরম দারিদ্র্যে আছেন দেড় কোটির কিছু বেশি মানুষ। এই সময়ে জন্মহার কমে গিয়ে দাড়ায় ১ দশমিক ১৬ শতাংশে।

নিজস্ব অর্থায়নে মেগাপ্রকল্প

আর্থিক সক্ষমতা বাড়ায় নিজেদের টাকায় মেগা প্রকল্প নির্মাণ এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব। পদ্মা সেতু এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি করা হচ্ছে। যেটির নির্মাণ কাজ বর্তমানে একদমই চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে (কাজের অগ্রগতি ৯০% এরও বেশি)। এই সেতু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে বলে মনে করা হচ্ছে। যা নির্মিত হলে দেশের জিডিপি ১.২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। পায়রা ও কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে আরও দুটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। দেশজুড়ে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে ৪০ বিলিয়ন বিদেশি বিনিয়োগ এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে।

খাদ্য নিরাপত্তায় সাফল্য 


ধানের বাম্পার ফলন, ছবি : সংগৃহীত

১৯৭২ সালে দেশের মোট খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৪০ লাখ টন। দ্বিগুণের বেশি জনসংখ্যার বাংলাদেশ বর্তমানে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এর মূল কারণ হচ্ছে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে ধান উৎপাদনের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয়। বাংলাদেশের চাষাবাদের জমি ধান ও পাট চাষের জন্য অনেক বেশি ব্যবহৃত হলেও সাম্প্রতিক সময়ে গমের চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৫০ লাখ মেট্রিক টন। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ (জানুয়ারি ২০২০) তথ্যানুসারে, বাংলাদেশ সবজি, ধান ও আলু উৎপাদনে বিশ্বে যথাক্রমে ৩য়, ৪র্থ ও ৭ম। এছাড়াও মাছে ৪র্থ, আমে ৭ম, পেয়ারায় ৮ম এবং খাদ্যশস্য উৎপাদনে বিশ্বে ১০ম। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) কৃষির অবদান ১৬.৬ %। দেশের ৪৫ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান হয় কৃষির মাধ্যমে।

বাংলাদেশের বিজ্ঞানী প্রয়াত মাকসুদুল আলম আবিষ্কার করেছেন পাটের জিনোম সিকুয়েন্সিং। সারা বিশ্বে আজ পর্যন্ত মাত্র ১৭টি উদ্ভিদের জিনোম সিকুয়েন্সিং করা হয়েছে, তার মধ্যে ড. মাকসুদ করেছেন তিনটি। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের বিশাল খনি রয়েছে। এছাড়াও কয়লা, খনিজ তেল প্রভৃতির ছোটোখাটো খনি রয়েছে।

সম্ভাবনাময় রপ্তানি খাত

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিস্টিক্যাল রিভিউ-২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুসারে সব মিলিয়ে বিশ্ব বাণিজ্যে বাংলাদেশ এখন ৪২তম বড় রপ্তানিকারক দেশ, আমদানিতে বাংলাদেশের অবস্থান ৩০তম। অগ্রসরমাণ অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়, ওপরে আছে কেবল ভিয়েতনাম। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩ হাজার ৪১৩ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এই আয় আগের অর্থবছরের চেয়ে ১১ দশমিক ৪৯ শতাংশ বেশি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানিতে আয় হয়েছিল ৩ হাজার ৬১ কোটি ডলার।

বিপরীতগামীতাসমূহ

দারিদ্র্য

বাংলাদেশের এই অর্থনৈতিক অগ্রগতির রয়েছে উল্টো চিত্রও। রয়েছে বেকারত্ব, সকল পর্যায়ে ঘুষ বাণিজ্য-দুর্নীতি, দারিদ্র্যতা, ব্যাংক কেলেঙ্কারির মতো ইত্যাদি নেতিবাচক দিকগুলো। করোনা মহামারি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল হওয়া বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি অনেকটাই অনিশ্চিত। যে কোনো সময়ই তা আবার মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। উদাহরণস্বরূপ করোনাকালে গত কয়েক মাসে দেশে শ্রমজীবী মানুষ ও অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত মানুষের কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়েছে। এ কারণে তাদের আয় কমেছে অন্তত ২০ শতাংশ। দারিদ্র্যের হার সাড়ে ১২ থেকে বেড়ে ২২ শতাংশ হয়েছে। অর্থাৎ দারিদ্র্য বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক বন্যার ক্ষয়ক্ষতি। বন্যায় ৩১ জেলায় ১ লাখ ৪২ হাজার টন ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যার মূল্য প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা। গত এপ্রিল -মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ে আম্ফানে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় সাড়ে ১১শ কোটি টাকায়। ঝড়ে দেশের ১৯ জেলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। করোনার কারণে কয়েক মাস লকডাউন ও দোকানপাট বন্ধ থাকায় অভ্যন্তরীণ ভোগ চাহিদা সংকুচিত হয়েছে। ফলে বেসরকারি বিনিয়োগে রয়েছে অনিশ্চয়তা, বিশেষ করে নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না। অর্থনীতির ম্যাক্রোসূচকের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি ও জিডিপির আকার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পারিপার্শ্বিক অবকাঠামো এবং জীবনযাত্রারও উন্নতি হওয়া দরকার, যা বাংলাদেশে এখনো হয়নি।

সামাজিক উত্তরণ সূচকে নিম্নগতি

পরিসংখ্যানগত সূচকের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মানুষের ভালো থাকা। শহর ও গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা, রাস্তাঘাট, গণপরিবহন, নাগরিকদের শিষ্টাচার প্রভৃতি দৃশ্যমান সূচকের উন্নতি হওয়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন মাপার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি জরুরি।

গত ১৯ জানুয়ারি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) সামাজিক উত্তরণ সূচক ২০২০ প্রকাশ করেছে। এতে বাংলাদেশ ৮২টি দেশের মধ্যে ৭৮তম স্থানে রয়েছে। সবার শীর্ষে আছে ডেনমার্ক। পরের দুটি স্থানে আছে নরওয়ে ও ফিনল্যান্ড। বাংলাদেশের পেছনে আছে পাকিস্তান, ক্যামেরুন, সেনেগাল ও আইভরিকোস্ট। দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কা আছে সবচেয়ে ভালো অবস্থায়, ৫৯তম। আর ভারত ও পাকিস্তান যথাক্রমে ৭৬ ও ৭৯তম।

ধনী ও দরিদ্রের আয় বৈষম্য

বাংলাদেশের মানুষের আয় ও আয় বৈষম্য দুটোই বাড়ছে। ১৯৯০ সালে গিনি সূচকে বাংলাদেশের বৈষম্য ছিল ২৮ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০১৩ সালে এই হার বেড়ে হয়েছে ৩২ দশমিক ১ শতাংশ। এর মানে, বৈশ্বিক সমতার হিসাবে বাংলাদেশের বৈষম্য বেড়েছে। ২০১২-১৭ সাল পর্যন্ত এ দেশে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ। দেশের সম্পদের বড় একটি অংশ তাদের হাতে চলে যাওয়ায় বৈষম্য অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। মাত্র ২৫৫ জন ব্যক্তির কাছে বাংলাদেশের বেশিরভাগ সম্পদ আটকে আছে। ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ গার্মেন্টস মালিকরাই।

অর্থপাচার

প্রতি বছর দেশ থেকে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। পাচারকারীদের অধিকাংশই গার্মেন্টস মালিক। মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম কিংবা কানাডায় ‘বেগম পাড়া’র বাড়ির মালিকদের মধ্যেও দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলী, আমলা, অর্থনীতিবিদ পরিবারের পাশাপাশি গার্মেন্টস মালিকদের পরিবারই বেশি অনুপাতে চিহ্নিত করা যাচ্ছে। কিন্তু এ খাতের ৩৫ লাখ শ্রমিক আগের মতোই দরিদ্র রয়ে গেছেন।

সরকারি তথ্যমতে, প্রায় সোয়া ৪ কোটি মানুষের মাথাপিছু আয় ৪ হাজার মার্কিন ডলারের ওপরে। অথচ কর দেন মাত্র ২০লাখ। নানান কারসাজির মাধ্যমে বিদেশে অবৈধপথে অর্থ পাচার করে বাংলাদেশিরা।

ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) বলেছে, ২০১৫ সালে বাণিজ্য কারসাজির মাধ্যমে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ বিদেশে পাচার হয়েছে। ২০১৪ সালে পাচার হয়েছে ৯১১ কোটি ডলার। টাকার অংকে যা প্রায় ৭২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। আমদানি-রপ্তানির সময়ে পণ্যের প্রকৃত মূল্য গোপন করার মাধ্যমেই এই অর্থের বড় অংশ পাচার করা হয়েছে। জিএফআই এর তথ্যমতে, তা ছিল ২০১৪-১৫  অর্থবছরের মূল্য সংযোজন কর (মূসক) খাতে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার সমান।

ব্যাংক কেলেঙ্কারি

গত ১০ বছরে ব্যাংক খাতের ১০টি বড় কেলেঙ্কারিতে লোপাট হয়েছে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। এসব কেলেঙ্কারি ঘটেছে মূলত সরকারি ব্যাংকে। সোনালী ব্যাংকের হল-মার্ক গ্রুপ দিয়ে শুরু হলেও সবচেয়ে বেশি কেলেঙ্কারি ঘটেছে জনতা ব্যাংকে। আরও রয়েছে বেসিক ও ফারমার্স ব্যাংকের অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা।

গত ১০ বছরে জনতা ব্যাংক থেকে অ্যাননটেক্স, ক্রিসেন্ট ও থারমেক্স গ্রুপ মিলে ১১ হাজার ২৩০ কোটি টাকা হাতিয়েছে। বেসিক ব্যাংক থেকে বের হয়ে গেছে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। সোনালী ব্যাংক থেকে হল-মার্ক নিয়ে গেছে ৩ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা। বিসমিল্লাহ গ্রুপ নিয়েছে ১ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া রিজার্ভ চুরির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে হারিয়েছে ৬৭৯ কোটি টাকা। নতুন প্রজন্মের এনআরবি কমার্শিয়াল ও ফারমার্স ব্যাংক থেকে লোপাট হয়েছে ১ হাজার ২০১ কোটি টাকা। এবি ব্যাংক থেকে পাচার হয়েছে ১৬৫ কোটি টাকা।

দুর্নীতি


দুর্নীতি, ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশে দুর্নীতি হলো একটি চলমান সমস্যা এছাড়াও দেশটি ২০০৫ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক প্রকাশিত তালিকায় পৃথিবীর তৎকালীন সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে স্থান লাভ করে। ভোগবাদী মানসিকতা এবং অনেক ক্ষেত্রে অভাব দুর্নীতির পেছনে দায়ী। তবে বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট দেখলে বোঝা যায় ভোগবাদী মানসিকতাই দায়ী। বাংলাদেশে বর্তমানে সব শ্রেণির ব্যক্তিরাই ঘুষ গ্রহণ করে থাকে। তবে উচ্চ পর্যায়ের কর্তারা মূলত তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করতে গিয়ে ঘুষ গ্রহণকে তাদের অভ্যাসে পরিণত করেছে। মধ্যবিত্তরা ও নিম্নবিত্তরাও তাদের জীবনযাত্রা মান উন্নয়নে ঘুষ গ্রহণ করে থাকে।

বাংলাদেশ দুর্নীতিতে প্রথম সারিতে ছিল এবং আছে পুলিশ, বিচার ব্যবস্থা, সেনাবাহিনী, রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী, পণ্য প্রস্তুতকারক, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি, স্থানীয় পর্যায়ের নেতা, বেসরকারি পেশাজীবিদের একটা বিরাট অংশ দুর্নীতিপরায়ণ। সবকিছু মিলিয়ে এখন জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশই বরাদ্দ করতে হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের বেতন ভাতার পেছনে। যাতে সরকারি কাজে দুর্নীতি কমে। ২০১৭ সালে করা টিআইবি’র একটি জরিপে বলা হয়েছে বাংলাদেশে সেবা সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি ঘটে থাকে। শতকরা ৬৬ ভাগ উত্তরদাতা একথাই বলেছেন। শতকরা ৮৯ জন ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন কারণ ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হাসিল হয় না।

করোনা মহামারি এসে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো দুর্নীতি কত প্রকারের হতে পারে। করোনার সার্টিফিকেট দেয় যে হাসপাতাল, সেই হাসপাতালের জালিয়াতির পর প্রকাশ পায়, হাসপাতালটির লাইসেন্সই ছিল না ছয় বছর ধরে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, দেশের অর্ধেকেরও বেশি বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকের লাইসেন্স মেয়াদোত্তীর্ণ। আর লাইসেন্সই নেই শতকরা ১০ শতাংশের। লাইসেন্স ছাড়াই এসব হাসপাতাল ক্লিনিক বাণিজ্য করে চলছে বছরের পর বছর। রিজেন্টের সাহেদ আর ও সাবরিনার জালিয়াতি নিয়ে বিশ্ব গণমাধ্যমে বাংলাদেশের খবর ছাপা হয়েছে, যা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে। দেশে মহামারিতে মানুষ প্রতিদিন মারা যাচ্ছে, সেই মহামারির প্রতিটি প্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে জালিয়াতি চলছে।রিজেন্টের সাহেদ একজন টকশো বোদ্ধা, মন্ত্রী মিনিস্টারের অত্যন্ত কাছের মানুষ।  ডা. সাবরিনা একজন কার্ডিয়াক সার্জন। সমাজের দায়িত্বশীল ও ওপরতলার নাগরিক।

দেড় হাজার কোটি টাকা নিয়ে কানাডায় পালানো পি কে হালদার বুয়েট থেকে পাস করা একজন ইঞ্জিনিয়ার। রূপপুর বালিশ প্রকল্পের প্রধান অভিযুক্ত ছিলেন একজন নির্বাহী প্রকৌশলী, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পর্দা কেলেঙ্কারির মূল হোতাদের চারজনই হলেন চিকিৎসক। জুম মিটিংয়ের অস্বাভাবিক খরচ দেখানো, আর রুপার দামে বটি কিনতে যাওয়া মানুষগুলো সবাই প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা।

তাদের দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ডের কারণেই বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষদের অর্জনগুলো ব্যর্থতায় পর্যবসিত হচ্ছে।


আরও পড়ুন-

রংপুর কারুপণ্য গ্রিন ফ্যক্টরি লিমিটেড যেন ‘সবুজ কর্মক্ষেত্র’
ইন্দিরা দেবী : রবীন্দ্রনাথের মানসসঙ্গী



মন্তব্য করুন